শালগাড়িয়ার জঙ্গলে
শালগাড়িয়ার জঙ্গলে
জাজাফী
আঠারশো পচাশি সাল।এখনকার মত চারদিকে উচু উচু দালনকোঠা তখন কল্পনারও বাইরে।সারা বিশ্বের ইংরেজদের শাসন চলছে।সেই ইংরেজদের অধীনে বাংলার আনাচে কানাচে নবাবী শাসনের ছোয়াও চোখে পড়ে। আমার বাবা ছিলেন এলাকার বেশ প্রভাবশালী আর অত্যন্ত সাহসী একজন মানুষ। সারাদিন এতো ব্যাস্ত থাকতেন যে রাতে শোবার সময় ছাড়া বাবার আর দেখা পেতাম না। তার পরও বাবা আমাদের খুব ভালবাসতেন।টাকা পয়সার খুব একটা অভাব ছিলনা বলেই বাবা কিছু চাওয়ার আগেই আমাদের আবদার গুলো পুরন করতেন।তিন ভাই এক বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। আমার বড় বোন মুনা ছিল অসম্ভব মেধাবী আর দেখতে ছিল রাজকন্যার মত। আমি কখনো রাজকন্যা দেখিনি কিন্তু মায়ের মূখে যখন রাজকন্যার গল্প শুনতাম তখন আমার বড় বোনটাও পাশে বসে গল্প শুনতো। মুনা আপু তখন মায়ের মূখের দিকে তাকিয়ে গল্প শুনতো আর আমি তাকিয়ে থাকতাম মুনা আপুর দিকে। গল্প বলা শেষ হলে মাঝে মাঝেই মুনা আপু মাকে জিজ্ঞেস করতো আচ্ছা আম্মি সত্যিকার কোন রাজকন্যাকে আপনি দেখেছেন কখনো? আমাদের সময়ে মাকে আম্মি ডাকা হতো আর আপনি করেই বেশি বলা হত। আম্মি বলতেন নারে মা আমি কি করে সত্যিকার রাজকন্যা দেখবো!হঠাৎ আম্মি আমার দিকে তাকাতেন আর আমি তখনও আমার বড় আপা মানে মুনা আপার দিকে তাকিয়ে আছি। আম্মি বলতেন এই ফাহিম কি দেখিস? আমি মুনা আপার দিক থেকে চোখ না সরিয়েই আম্মিকে বলতাম আম্মি আমি রাজকন্যা দেখি! আম্মি হেসে দিয়ে বলতেন রাজকন্যা কোথায় পেলি? আমি আমার বড় বোন মুনা আপাকে দেখিয়ে বলতাম এইতো আমাদের রাজকন্যা। আপনি যেভাবে বলেছেন মুনা আপার মাঝেতো সব আছে।মুনা আপাতো রাজকন্যার চেয়েও সুন্দর। মুনা আপা আমাকে আলতো খোচা দিয়ে বলতো তুমি সত্যিকার কোন রাজকন্যা দেখেছ যে আমাকে বলছো রাজকন্যা? আমি মুনা আপাকে বলতাম আপা তুমিই আমার চোখে রাজকন্যা। মাঝে মাঝে মনে হত মুনা আপা শুধু রাজকন্যাই নয় সে তার থেকেও বেশি। আমি গল্পে পরীদের কথা শুনেছি আমার বড় আপা ঠিক যেন নীল পরী।জীবন এরকমই এই সুখ এই বেদনা। হঠাৎ করেই আমি খুব একা হয়ে পড়লাম। মুনা আপা বিলেত গেল পড়তে। আর বড় ভাইয়াও কোলকাতা চলে গেল পড়া লেখা করতে। তখনকার কোলকাতা ছিল শিক্ষানগরী। এদেশ থেকে মানুষ কোলকাতা যেত পড়তে। আর যারা অনেক মেধাবী ছিল তারা যেত বিলেতে।মুনা আপা আর বড় ভাই চলে যাওয়ার পর আমি সত্যি সত্যি খুব একা হয়ে পড়লাম। মুনা আপা ছিল আমার বোন আর আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু।আমি বলতে গেলে হাটা শিখেছি মুনা আপার হাত ধরে কথা বলা শিখেছি মুনা আপার কথা শুনে আর খাওয়া শিখেছি মুনা আপার হাতে তুলে খাইয়ে দেয়ার কারণে। হঠাৎ করে মুনা আপা বিলেত চলে যাওয়ায় আমি যেন দিশেহারা হয়ে পড়লাম।খেতে গেলেই মনে হতো আমি বোধহয় নিজ হাতে তুলে খেতে ভুলে গেছি। হাটতে গেলে মনে হতো আমি যেন পড়ে যাব।আমার পুরো পৃথিবী তখন এলো মেলো। কেউ বিশ্বাসই করতে পারবেনা কি অসম্ভব কষ্টের মধ্যে আমি পড়েছি।আমার কষ্টটা বাবা বুঝতেন খুব ভাল ভাবেই। আগের তুলনায় তিনি একটু আগেআগেই বাড়ি ফিরতে চেষ্টা করতেন।আমার পাশে বসে আমাকে গল্প শোনাতেন। আম্মজান যখন গল্প বলতেন তখন শুধু রাজা বাদশাদের গল্প শোনাতেন আর রুপকথা শোনাতেন। আর আব্বা কখনো আগে আমাকে গল্প শোনাতেন না। আব্বা কত কাজে ব্যাস্ত থাকতেন তার গল্প বলার সময় কোথায়। কিন্তু মুনা আপা চলে যাওয়ার পর আমি যখন খুব বিষন্ন হয়ে পড়লাম তখন বাবাও আমার কষ্টটা বুঝতে পারলেন। তাই গল্প বলে আমাকে কিছুটা আনন্দ দিতে চেষ্টা করতেন। প্রথম দু একদিন আব্বার বলা গল্প আমার মোটেও ভাল লাগতোনা। আব্বা গল্প বলায় কোন আকর্ষনীয়তা আনতে পারতেন না। মনে হতো সেটা কোন গল্প নয় ক্লাসের কোন জ্যামিতির উপপাদ্য বুঝাচ্ছেন। যদিও আমি সেই বয়সে জ্যামিতি কি তা জানতাম না। এর দুএকদিন পরই অন্যরকম একটা ব্যাপার ঘটে গেল। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আব্বা এমন সুন্দর গল্প বলছেন তা যেন গল্প নয় আমার চোখের সামনে ঘটে চলেছে। আব্বার গল্প আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতাম। আব্বার সব গল্পই ছিল বীর যোদ্ধাদের নিয়ে।চেঙ্গিস খানকে নিয়ে আব্বা এমন সব গল্প বলতেন যা মনে হত সেগুলো অসম্ভব। আমি মুগ্ধ হয়ে একদিন আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম আব্বা আপনার বলা গল্প আমার এতো বেশি ভাল লাগে কেন? আর এতো বেশি বাস্তব মনে হয় কেন? আব্বা মুচকি হাসি দিয়ে বলেছিলেন আমার বলা গল্প গুলো আসলেই বাস্তব। আর তুমি যেহেতু ছেলে মানুষ তাই তোমার কাছে বীর যোদ্ধাদের গল্প ভাললাগাই স্বাভাবিক। আর মুনার কাছে রুপকথার গল্প রাজকন্যার গল্প ভাল লাগাই স্বাভাবিক।
আমাদের বাড়ির পাশে একটা নদী ছিল। সেই নদীটার অসাধারন একটা নাম ইছামতি। কেমন যেন মায়া মায়া জড়ানো একটা নাম।ইছামতি নদীর ধার ঘেসে ছিল একটা অনেক বড় জঙ্গল। সেই জঙ্গলের নাম শালগাড়িয়ার জঙ্গল।বাবার মুখে কত বার যে শালগাড়িয়ার জঙ্গলের নাম শুনেছি তার কোন হিসাব নেই।আমার দাদুর একটা দো নালা বন্দুক ছিল। উনি ছিলেন মস্তবড় শিকারী। আমি আমার দাদুকে কখনোই দেখিনি। কিন্তু আমার দাদুর ঘরের দেয়ালে হরিনের চামড়া দেখেছি আর দেখেছি হৃদয় কাপানো রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া। আব্বার মুখে শুনেছি দাদুই বাঢ় শিকার করেছেন।দাদুর বাঘ শিকারের গল্প শুনলে নিজেকেই শিকারী মনে হতো।দাদুর সেই দো নালা বন্দুকটি দাদুর ঘরের একটা ট্রাংকে তালা লাগানো আছে। আব্বা একদিন আমাকে সেই বন্দুকটি দেখিয়েছিলেন।আমি আব্বাকে বললাম আব্বা আমি একটু ছুয়ে দেখি! আব্বা হাসি হাসি মুখে বলেছিলেন ঠিক আছে দেখ। তোমার দাদুর হাতের ছোয়া আছে। আমি পরম মমতায় দাদুর ছোয়া যুক্ত সেই দোনালা বন্দুক ছুয়ে দেখলাম।ইস আমার যদি এরকম একটা বন্দুক থাকতো আমিও দাদুর মত শিকার করতাম। কেবল ইছামতী নদীর ওপাড়েই জঙ্গল ছিল তা নয় আসলে পুরো দেশটাই জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। সেই সব জঙ্গলে বাস করতো নানা ধরনের প্রানী।কিন্তু শালগাড়িয়ার জঙ্গল ছিল অন্যরকম। কারণ ওখানে ছিল অনেক অনেক বাঘ। প্রতি পুর্নিমার রাতে আমি আব্বার সাথে আমাদের বাড়ির ছাদে উঠতাম বাঘ দেখার জন্য। পুর্নিমার রাতে বাঘ নদীর কিনারে এসে নদীর পানি খেত। হয়তো অন্য সময়ও খেত কিন্তু আমাদের চোখে পড়তোনা। আমি বেশ অনেক বার আব্বার সাথে ছাদে বসে বাঘ দেখেছি। কী ভয়াল গর্জন দিত যেন পুরো পৃথিবীটাই কেপে উঠছে।হঠাৎ বড় ভাইয়া বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লো। আব্বা কোলকাতা যাবেন বলে ঠিক করলেন। আমি বোধহয় আবারও একা হয়ে পড়ছি। আব্বা রাতে কত যুদ্ধের গল্প বলতেন আর আমি নিজেই একজন বীর যোদ্ধা হয়ে উঠতাম আব্বা কোলকাতা গেলে সেই কয়দিন আমি কিভাবে থাকবো ভেবে পাচ্ছিলামনা। রাতে আব্বা খাবার সময় বললেন পরদিন সকালেই তিনি কোলকাতা রওনা হবেন। কোলকাতাতো কাছের পথ না যে চাইলাম আর চলে গেলাম।আমি কোন কথা না বলে মনখারাপ করে নিজের ঘরে চলে গেলাম। আব্বা কিছুক্ষণ পর আসলেন এবং আমাকে গল্প বলবেন বলে স্থির করলেন। আমার মনটা ভালনেই। গল্প শুনতেও ইচ্ছে করছিলনা। আব্বা হঠাৎ কি যেন ভাবলেন তার পর বললেন তোর জন্য একটা জিনিষ এনেছি তোকেতো দেওয়াই হয়নি। বলে আব্বা উঠে দাড়ালেন এবং কিছুক্ষণ পরই একটা ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে আমার ঘরে ফিরে এসে আমার হাতে ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন নে এটা তোর জন্য। আমি বললাম আব্বা এটা কি? আব্বা বললেন খুলেই দেখ। আমি ব্যাগটা খুলেই ভীষণ খুশি হলাম। ওটা ছিল একটা দো নালা বন্দুক! তবে ওটা সত্যি বন্দুক ছিলনা। ওটা ছিল একটা খেলনা বন্দুক। কিন্তু মজার ব্যাপার হল ওই বন্দুকটাতেও বারুদ ভরা থাকতো আর ট্রিগার টিপলে ঠাস ঠাস শব্দ হত।আমি ওটা পেয়ে যেন আকাশের চাদ হাতে পেলাম। আব্বাকে বললাম আব্বা আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। আব্বা সেদিন আমার কাধে হাত রেখে বলেছিলেন আমিতো তোমাকে খুশি করার জন্যই এটা কিনে এনেছি।সেদিন সেই খেলনা বন্দুক হাতে নিয়েই আমার মনে হচ্ছিল আমিও কোন বাঘ শিকারী। পরদিন সকালেই বাবা ভাইয়ার সাথে দেখা করার জন্য কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। যাবার আগে বলে গেলেন একা একা ঘরে বসে না থেকে বাড়ির আশপাশটা ঘুরে দেখো তাহলে মন ভাল থাকবে। তবে খুব বেশি দূরে যাবেনা। আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।আমার যেহেতু আর কোন কাজ ছিলনা তাই বেশ ঘুরে ফিরে দেখতে লাগলাম। বিকেলে ইছামতি নদীর ধারে ধারে হাটতে লাগলাম। আহ কী যে আনন্দ হচ্ছিল। তবে মুনা আপা থাকলে আমার আনন্দ আরো অনেক বেড়ে যেত। মুনা আপা আমার বড় বোন হলেও সেই আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু। না জানি বিলেতে গিয়ে মুনা আপা কেমন আছে কি করছে। আমার মনে হয় নিশ্চই খুব ভাল আছে। শুনেছি বিলেত নাকি এমন এক জায়গা যেখানে গেলে মানুষ বাবা মায়ের কথাও বেমালুম ভুলে যেতে পারে। আমার ভাবনা হয় আমার মুনা আপাকি তবে আমাকেও ভুলে গেছে? আমার বিশ্বাস হয়না। মুনা আপা পুরো পৃথিবীকে ভুলে যেতে পারে কিন্তু তার ছোট ভাই এই আমাকে ভুলে যেতে পারেনা। মুনা আপা থাকলে ইছামতি নদীর তীরে হাটতে হাটতেই হয়তো হাতে আজলা ভর্তি পানি নিয়ে আমার দিকে ছুড়ে দিয়ে বলতো রাজপুত্তুরকে ভিজিয়ে দিলাম। মুনা আপা আমাকে মাঝে মাঝে আদর করে রাজপুত্তুর বলে। কারণ আমিও যে আমার আপুকে রাজকন্যা বলতাম।মুনা আপা আমাকে যে নামেই ডাকুকনা কেন আমার ভাল লাগে। আমি আমার বোনকে অনেক অনেক ভালবাসি। সেই যে মুনা আপা বিলেত গেল আর কোন খোজ নেই। হয়তো এর মাঝে আব্বাকে চিঠি লিখেছে কিংবা শহরে গিয়ে আব্বা হয়তো টেলিফোনে কথাও বলেছে।আব্বার মূখে শুনেছি আলেক্সান্ডার গ্রাহাম্বেল নামের এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী টেলিফোন আবিস্কার করেছেন।দুই তিন দিন এভাবেই ইছামতির তীর ধরে হেটেছি আর শালগড়িয়ার জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে থেকেছি। ইছামতী নদী নদী হলেও সব সময় হাটু সমান পানি থাকতো। বড়দের যেহেতু হাটু সমান পানি তাই আমার ক্ষেত্রে সেটা বুক সমান। এটা তেমন কোন সমস্যা না। আমি বেশ ভাল সাতার জানি।বাবা নিজে আমাকে সাতার শিখিয়েছেন।মাঝে মাঝেই মনে হয় ইস যদি শালগড়িয়ার জঙ্গলের ভিতরটা কেমন দেখতে পারতাম। ভেবে রেখেছি আব্বা ফিরে আসলে একদিন আব্বাকে বলবো শালগড়িয়ার জঙ্গলে নিয়ে যেতে। নিয়ে যাবে কিনা তা অবশ্য জানিনা। পরদিন আবার বিকেলে ইছামতী নদীর তীরে হাটছি। হাতে আব্বার কিনে দেয়া খেলনা দোনালা বন্দুক। খেলনা হলেও বারুদ আছে এবং ট্রিগার টিপলে বেশ জোরেই গুলির শব্দ হয়।আমি হাটছি আর ও পাশে বেশ কিছু হরিণ হেটে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। আমি ভাবলাম দেখিনা কত শব্দ হয় তাই ট্রিগার টিপে দিলাম। সাথে সাথে বিকট শব্দ হল এবং সেই শব্দে ভয় পেয়ে হরিণগুলো ছোটাছুটি করে পালাতে লাগলো। আমার খুব মায়া হলো ইস ওরা থাকতো আরো কিছুক্ষণ। তবে ভাল লাগলো এই দেখে যে খেলনা বন্দুকটাতেও অনেক শব্দ হয়।আমার দাদুর ঘরের দেয়ালে দাদুর বেশ কয়েকটা ছবি বাধানো আছে। সেই ছবি দেখে দেখে দাদুর চেহারা আমার চোখে আটকে আছে। আমি আমার দাদুকে কাছে না পেলেও তাকে খুব চিনতে পারি। আব্বা কোলকাতা থেকে ফিরে আসতে আরো দশ বারদিন লাগবে বলে শুনলাম। আম্মি রাতে আমাকে গল্প বলেন। আগে যে সব গল্প মুগ্ধ হয়ে শুনতাম সেগুলো এখন আর ভাল লাগেনা। আমি আম্মিকে যুদ্ধের গল্প বলতে বলি আর আম্মি বলে আমি যুদ্ধের গল্প ভাল বলতে পারিনা।আমার বয়স এগার বছর।আর আমার বড় ভাইয়ার বয়স উনিশ। আমাদের ভাই বোনদের মধ্যে মুনা আপা সবার বড়। সে বিলেত গেছে ব্যারিস্টারী পড়তে।আমার বলতে গেলে কোন বন্ধু নেই। এই এলাকার ছোট ছেলে মেয়েরা আমার সাথে মিশতে চায়না । এর কারণ হিসেবে আমি বের করেছি আমার বাবা অনেক ক্ষমতাশালী হয়তো এ জন্য ওরা আমার সাথে মিশতে চায়না। অথবা আমি ঠিকমত গুছিয়ে কথা বলতে পারিনা বলে ওরা মেশেনা। আমার চারদিকে কত আলো বাতাস আর পাখিদের আনাগোনা। ওরাই আমার বন্ধু। এই প্রকৃতি আমার বন্ধু। আমি ইছামতির তীরে হাটি খালি পায়ে আর আমার পা ভিজিয়ে দিয়ে ইছামতি যেমন আনন্দ পায় আমিও আনন্দ পাই। এক রাতে বালিশের নিচেয় আমার খেলনা বন্দুক রেখে ঘুমোতে গেছি। আমি তখন গভীর ঘুমে কিনা বলতে পারবোনা হঠাৎ শুনি দরজায় খটখট শব্দ হচ্ছে। আমি উঠে দরজা খুলতেই দেখি দাদু হাতে তার সেই বিখ্যাত দো নালা বন্দুক নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আমি দাদুর সাথে তুমি তুমি করেই কথা বলতাম। দাদুকে সেই ঘুম জড়ানো চোখেই বললাম দাদু তুমি এতো রাতে বন্দুক নিয়ে কি করো? আমার ঘরে আসছো কেন? দাদু বললেন নে তৈরি হয়ে নে আজ রাতেই বাঘ শিকার করতে শালগড়িয়ার জঙ্গলে যাব। শালগড়িয়ার জঙ্গলের কথা শুনেই আমার চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে গেল। আমার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো।আমি দাদুকে বললাম দাদু তুমি আমার বিছানায় একটু বসো আমি এখনি রেডি হচ্ছি। দাদুকে জিজ্ঞেস করলাম দাদু ছোট্ট একটা ব্যাগ কি সাথে নিতে পারি? দাদু বললেন অবশ্যই নিতে পার। কারণ খাবার পানি বিস্কুট এগুলো নিলে তোমারই সুবিধা। আমি দাদুর কথা মত যা নেয়া দরকার সব নিয়ে নিলাম। এমনকি বালিশের নিচে থেকে আমার নিজের দোনালা ছোট্ট বন্দুকটাও নিলাম। ওটা যখন বের করছি দাদু ওটা দেখে বললো ওমা একি এতো সুন্দর বন্দুক তোকে কে দিল?আমি দাদুকে বললাম দাদু এটা আব্বা আমাকে কিনে দিয়েছে।দাদু খানিকটা অভিমানের সুরে বললেন তোর আব্বা কোলকাতা থেকে ফিরুক তার পর তার সাথে বোঝাপড়া করবো। নিজের ছেলেকে অমন সুন্দর একটা বন্দুক কিনে দিতে পারে আর বাপকে কিনে দিতে পারেনা! আমি দাদুকে বললাম হিংসে করোনা দাদু চলো যাই। সেই রাতের অন্ধকারে কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দাদুর সাথে বেরিয়ে পড়লাম শালগড়িয়ার জঙ্গলে বাঘ শিকার করতে। সামনে আমার বাঘ শিকারী অসম সাহসী দাদু আর তার পিছনে এগার বছরের আমি।যেতে যেতে রাতের সেই গহীন অন্ধকারে কত কত প্রানীর ডাক শুনলাম। মাঝে মাঝে ভয়ে শিউরে উঠছিলাম। কিন্তু দাদু বার বার বললেন ভয় হল মনের ব্যাপার। তুই ভয়কে প্রশ্রয় দিবি তো ভয় তোর মনে স্থায়ী আসন গেড়ে বসবে। তখন দেখবি একটা তেলাপোকাকেও তোর মনে হবে ডাইনোসর। দাদুর কথা শুনে আমি সাহস পেলাম।আমি দাদুর কাছ থেকে আরো অনেক অনেক কিছু জানতে লাগলাম। ইছামতী নদীর যে দিকটাতে আমি রোজ হাটাহাটি করতাম দাদু আমাকে ঠিক তার থেকে অন্য একটা জায়গা নিয়ে আসলেন। সেখানে চারদিকে জঙ্গল আরো বেশি ঘন। কোথাও কোন আলো নেই। কেবল আমার হাতের ছো্ট্ট একটা টর্চ আর দাদুর হাতের টর্চ। এই টর্চটাও কী অদ্ভুত ভাবেইনা বানানো। মাঝে মাঝে ভাবি কে বানিয়েছিল এই টর্চ! কী সুন্দর আলো দেয়।সুনশান নিরবতার মাঝেই অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে পাতা ভাঙ্গার শব্দ। দাদু বললেন ওটা বাঘের পায়ের নিচে চাপা পড়ে শুকনো পাতার মরমর শব্দ।কত রাত সেটা আমি ঠিক জানিনা। আমাদের কাছে সময় জানার মত কোন কিছু ছিলনা।আমি আর দাদু যেখানে এসে দাড়িয়েছি ঠিক সেখানে ইছামতি নদীর পানি বোধহয় অনেক বেশি। দাদুকে বললাম এখন নদী পার হবে কিভাবে?সাতরে? দাদু বললেন দাড়া নৌকায় করে পার হব। আমি সেই অন্ধকারে লাইট মেরে আশে পাশে তাকালাম কিন্তু কোথাও কোন নৌকা পেলাম না। কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল দাদু যখন বলেছেন তখন নৌকার কোন না কোন ব্যাবস্থা হবেই। দাদু বেশ উচু গলায় ডাকলেন নজু আছ নাকি? মাত্র দুবার ডাক দেবার পরই নজু নামের লোকটা সাড়া দিল। বললো কাকা খাড়ান আইতাছি। এর কিছুক্ষনের মধ্যেই নজু নামের মাঝিকে কিনারে আসতে দেখলাম। দাদু নিজে আগে না উঠে আমাকে উঠতে বললেন। বললেন খুব সাবধানে ওঠ ফাহিম। আমি সাবধানে ওঠার পর দাদু আমার হাতে তার দোনালা বন্দুকটা দিয়ে বললেন নে এটা ধর তার পর আমি উঠি। দাদু উঠে বসার পর নজু মাঝি নৌকা ছেড়ে দিলেন।নৌকা বেশি একটা জোরে যেতে পারছেনা কারণ নদীতে বেশ স্রোত। আমি আশ্চর্য হয়ে দাদুকে জিজ্ঞেস করলাম দাদু ইছামতি নদীতে তো স্রোত থাকার কথা নয়। আমিতো কখনো স্রোত দেখিনি। দাদু শুধু একটু হাসলেন কিন্তু কিছু বললেন না। নজু মাঝি বললো রাতের অন্ধকারে ইছামতী তার রুপ পাল্টায়। আমি বুঝলাম ইছামতিতে রাতে স্রোত বয়।অনেক ক্ষন পর আমরা একটা যায়গায় এসে নদীর কিনারে থামলাম। দাদু আবারও আমাকে সাবধানে নামতে বললেন। তবে এবার দাদু আগে নামলেন আর আমাকে পরে নামতে বললেন।বিষয়টা দাদুকে জিজ্ঞেস করতেই দাদু হেসে উঠলেন কিন্তু কিছুই বললেন না। ভাবলাম আগের বারের মতই বোধহয় নজু মাঝি কিছু একটা বলবে কিন্তু সেও বললো না। নজু মাঝিকে দাদু কি সব বলে আমাকে নিয়ে শালগড়িয়ার জঙ্গলে ঢুকতে শুরু করলেন। আমার গা ছমছম করতে লাগলো। আমি অবশ্য দাদুকে সেটা বুঝতে দিলাম না। দাদুতো বলেছেন ভয়কে মনে স্থান দিবিনা তাহলেই সে স্থায়ী ভাবে তোর মনে ঢুকে পড়বে। তখন সব কিছুতেই ভয় পাবি। আমিও ভয়কে দূরে সরিয়ে রাখছি।দুই পাশে গভীর জঙ্গল মাঝখানে সরু রাস্তা। পায়ে হাটা পথের মত অনেকটা। দাদু বললেন মৌয়ালরা মধু সংগ্রহের জন্য এই পথ দিয়ে যাওয়া আসা করে বলে এরকম পথ হয়েছে। আমি দাদুর কাছে জানতে চাইলাম দাদু শালগড়িয়ার জঙ্গল কত বড়? তুমিকি এটা পুরো ঘুরে দেখেছ? দাদু মুচকি হেসে বললেন তুই দাদু কল্পনাও করতে পারবিনা যে শালগড়িয়ার জঙ্গল কত বড়। এই যে এক দিক দিয়ে ঢুকে গেলাম আমরা যদি চলতেই থাকি চলতেই থাকি তাহলে নেপালের হিমালয়ের কাছে পৌছে যাব। এটা অনেকটা আমাজনের মত। আমি অনেক বছর ধরে এই জঙ্গলে ঘুরেছি। এর প্রায় অধিকাংশ স্থান আমার চেনা।এখন এই শালগড়িয়ার জঙ্গলের দক্ষিণ দিক ধরে হাটতে থাকলে তুই এক সময় পশুর নদী পাবি। সেই পশুর নদীর তীর ঘেসে সুন্দর বন বিশাল এরিয়া নিয়ে বিশ্বের মানচিত্রকে সমৃদ্ধ করেছে।দাদু যেভাবে হাটছিল দেখে কে বলবে দাদুর বয়স তিরানব্বই বছর। শরীরের চামড়ায় অল্প অল্প বয়সের ছাপ পড়েছে কিন্ত মনে আছে দূরন্ত কৈশর যৌবন সব।আমি দাদুর পাশে পাশে হাটছি। দাদু আমাকে বলে দিচ্ছে জঙ্গলের মধ্যে কিভাবে চলাফেরা করতে হয়। শালগড়িয়ার জঙ্গলে বাঘ আছে সাড়ে সাতশোর মত।বিশাল এরিয়া জুড়ে শালগড়িয়ার জঙ্গল বিস্তৃত বলেই বাঘেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শিকারের খোজে তারা সব সময় ঘুরে বেড়ায়। সামনে পেলেই আর নিস্তার নেই। বিশ্ববিখ্যাত শিকারী জোহান প্যান্টম একবার এই জঙ্গলে এসেছিলেন বাঘ শিকার করতে। তার সাথে ছিল আরো গোটা দশেক শিকারী। সেই শিকার দলের তিন জন বাঘের পেটে গিয়েছিল। যদিও বিশ্ববিখ্যাত শিকারী জোহান প্যান্টম একাই তিনটা বাঘ শিকার করেছিলেন। তাই এই জঙ্গল মোটেও নিরাপদ নয় যদিনা দেখে শুনে বুঝে চলা না যায়। আমি দাদুর কথা শুনছিলাম আর দেখে শুনে সজাগ হয়ে হাটছিলাম।কত দূরে এসেছি জানিনা। বেশ অনেক গভীরে হয়তো এসেছি। একটা হরিণকে দেখলাম আমাদের সামনে দিয়ে লাফিয়ে সরে গেল।আমি কিছু বলার আগেই দাদু বললেন সাবধান ফাহিম বাঘ আসছে। আমি ফিসফিস করে দাদুকে বললাম কিভাবে বুঝলে যে বাঘ আসছে। দাদু বললেন সেটা পরে শুনিস। দাদু বন্দুকটা তাক করে এগোতে লাগলেন।আমিও আমার বন্দুকটা তাক করে এগোতে লাগলাম। হঠাৎ করে জঙ্গলের এই স্থানটাকে খুব ফাকা মনে হলো। যেন কোন গাছ নেই,কোন শব্দ নেই। রাতের অন্ধকারে জঙ্গলে নানান শব্দ শোনা যায় অথচ এই স্থানটাতে কোন শব্দ নেই।আমি আর আমার দাদু পিঠে পিঠ রেখে বন্দুক হাতে দাড়িয়ে গেলাম। সেই অন্ধকারেই দেখলাম পিলে চমকানো দৃশ্য। উত্তর দিকের ঘন জঙ্গলের ভিতর থেকে গুটি গুটি পায়ে সে এগিয়ে আসছে। অন্ধকারেই ওর চোখটা জ্বলজ্বল করছে। দাদু বললেন আর মাত্র পাচ সেকেন্ড পরই গুলি করতে হবে।আমি দাদুর কথা মত ট্রিগারে হাত দিয়ে রেখেছি। বাঘটা আমাদের দিকে আসতে গিয়ে কিছুটা ঝুকে বসলো। বুঝলাম শিকারের উদ্দেশ্যে লাফ দেয়ার জন্য নিচু হয়েছে। দাদু আর দেরি করলেন না।ট্রিগার টিপে দিলেন সেই সাথে আমিও ট্রিগার টিপলাম। একটা গগণ বিদারী চিৎকার দিয়ে বাঘটি হাচড়ে পাচড়ে আমাদের দিকে লাফ দিল। সেই অবস্থায়ই আবার গুলি চালানো হলো। আর সময় মত আমরা দুজন লাফিয়ে সরে গেলাম। আমরা সরে গেলেও আমাদের গুলি ঠিকই বাঘটার শরীর ভেদ করলো।ঠিক একটু দূরে সে লুটিয়ে পড়লো। চারদিকে পাখিরা ডেকে উঠলো। রাতের অন্ধকারে পাখিরা কখনো ডাকেনা। সম্ভবত গুলির শব্দে তাদেরও ঘুম ভেঙ্গে গেছে। তারাও চমকে উঠে কিচিরমিচির করে উঠছে।আহত বাঘটি কিছুক্ষণ কষ্টে চিৎকার করে একসময় নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইলো। আমি বুকে সাহস নিয়ে দাদুকে বললাম দাদু বাঘটা কি মরে গেছে? আমি কি যাব ওটার কাছে? দাদু বললেন যা ওটা শেষ। আমি ওর কাছে এগিয়ে গেলাম।সাহস নিয়ে ওর লোমশ শরীরে হাত রাখলাম। শরীরটা থরথর করে কাপছে আর ওর লোমশ শরীরটা বেশ গরম। টর্চ মেরে দেখলাম ওর সারা গায়ে ডোরাকাটা। দেখলেই সারা শরীর কাটা দিয়ে ওঠে।আমি দাদুকে প্রশ্ন করলাম আচ্ছা দাদু বাঘের শরীর এতো গরম কেন? দাদুর কোন সাড়া শব্দ নেই। আমি পিছনে ফিরেই চমকে উঠলাম। দাদু নেই। ভয় পাব না পাব না বলছিলাম এবার ভয়ে আমার প্রান যায় যায় অবস্থা।আমি দাদু দাদু বলে কয়েকবার ডেকেও দাদুর কোন সাড়া পেলাম না।দাদুকে কি তবে অন্য একটা বাঘে ধরে নিয়ে গেল। তাহলেওতো দাদুর চিৎকার বা শব্দ পেতাম। চার দিকে গভীর জঙ্গল কোথাও কেউ নেই। কোন সাড়া শব্দ নেই। এমনকি একটা পাতা ঝরার শব্দও না।আমার চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি গড়াতে লাগলো। মূখ দিয়ে ভয়ে কান্নার শব্দও বের হলনা। আমি সেই মৃত বাঘের পাশের ফাকা জায়গাটাতে বার কয়েক ঘুরে দাদুকে খুজলাম কিন্তু দাদুকে খুজে পেলাম না।হঠাৎ দেখলাম দাদুর দো নালা বন্দুকটা আমার হাতে। আমি আবারও চমকে উঠলাম।দাদুর বন্দুক আমার হাতে আসবে কেন?দাদুর বন্দুকতো দাদুর হাতেই ছিল।আমি আচমকাই আমার পকেটে হাত দিলাম। নাহ সেখানে আমার নিজের বন্দুকটাও নেই।আমি মনে মনে বললাম সব আমার কল্পনা। আসলে দাদু কল্পনাতেই এসেছিল আর চলে গেছে। কিন্তু আবার মনে হল তাহলে ওই মৃত বাঘটা! আমি বাঘের গায়ে আবার হাত দিলাম এবং বাঘের অস্তিত্ব টের পেলাম। কিন্তু বার বার কেন যেন মনে হতে লাগলো আমি ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছি।কিছুক্ষণ পর দাদু যেমন নেই হয়ে গেছে বাঘটাও থাকবেনা।আমি সেই মৃত বাঘটার পাশে হতাশ হয়ে বসে পড়লাম। আমার হাতে দাদুর দোনালা বন্দুক। যে বন্দুকের গুলিতে কিছুক্ষণ আগেই দাদু বাঘটাকে শিকার করেছে।রাত আর যেন পোহাতে চায়না। আমার গায়ে চিমটি কেটে দেখলাম আমি কি স্বপ্ন দেখছি নাকি জেগে আছি। চিমটি কাটার পর নিজেই উহ করে উঠলাম।
চলবে.....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন