(লেখাটি দৈনিক ইত্তেফাকের উপসম্পাদকীয়তে প্রকাশিত)
জাজাফী
সম্প্রতি ফ্রান্সে যে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটেছে তা নিয়ে
সারা বিশ্বে নিন্দা ক্ষোভ প্রকাশের মহড়া দেখা গেছে।সেই ধারা অব্যাহত ছিল
বাংলাদেশীদের মধ্যেও। এটা অবশ্যই স্বাভাবিক যে,যে কোন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে আমরা
অবস্থান করবো এবং ওগুলোকে ঘৃণা করবো।
এই ঘৃণা প্রকাশের রীতি বহুপুরাতন হলেও এখন নতুন ভাবে সেটা
প্রকাশ হচ্ছে। এবং সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে ফেসবুক নামক আজব দুনিয়ার
আগমনের মাধ্যমে।ফ্রান্সে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় যখন গোটা বিশ্ব
ক্ষোভে ফেটে পড়ছে তখন ফেসবুক একটা অ্যাপস বানিয়েছে যার মাধ্যমে ফ্রান্সকে
সাপোর্ট করার জন্য নিজের ফেসবুক প্রোফাইলের ছবিটি ফ্রান্সের পতাকার আদলে
রাঙিয়ে নেওয়া যাবে। আর এটা ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে যে কোন মহামারির থেকেও
দ্রুত গতিতে।
যদি ১৪৯ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর মধ্যে কমপক্ষে ৮০ কোটি
ব্যবহারকারী এটা করেছে।কিন্তু আমাদের কাছে মোটেও বোধগম্য হয়নি যে ফ্রান্সে
সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদ স্বরুপ ফ্রান্সের পতাকায় নিজের ফেসবুক
প্রোফাইল রাঙিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে কিভাবে প্রতিবাদ করা হলো বা ফ্রান্সকে কিসের
ব্যাপারে সাপোর্ট করা হলো।ধরে নেওয়া যাক যে এটা একটা অভিনব পন্থা এবং সত্যি
সত্যি কেউ যদি তার ফেসবুক প্রোফাইল ফ্রান্সের পতাকার রঙে রাঙিয়ে
নেয় তবে সে ফ্রান্সে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনার নিন্দা জানাতেই এই
পদক্ষেপ নিয়েছে।
এখানেই অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন এই বলে যে গোটা বিশ্বে,
বিশেষ করে সিরিয়া,আফগানস্থান আর ফিলিস্তিনে
দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম নিধন চলছে,কিংবা মুসলিম নিধনের সাথে সাথে সেই সব হামলায় অন্যান্য
ধর্মাবলম্বীরাও মারা যাচ্ছে আর তা হিসাব করলে ফ্রান্সের হামলায় যতজন মারা গেছে
তার থেকে কয়েক হাজার গুন বেশি। সেই সব হামলার প্রতিবাদেতো কেউ কোন দিন সেই সব দেশের পতাকার রঙে
নিজেদের ফেসবুক প্রোফাইল পরিবর্তন করেনি।
রানা প্লাজা ধ্বসে অনেক মানুষ মারা গেছে যদিও সেটা দুর্ঘটনা
ছিল তার পরও সেটার সমব্যাথী হয়ে কেউতো ওভাবে বাংলাদেশের পতাকায় নিজেদের
প্রোফাইল রাঙায়নি। নাকি তখন ফেসবুক ছিলনা?পিনাক নামক লঞ্চ ডুবে যখন অনেক মানুষের প্রাণহানি
ঘটলো তখনো বাঙ্গালীরা নিশ্চুপ ছিল অন্তত ফেসবুকীয় আঙ্গিনায়।একেই বলে হুজুগে বাঙ্গালী।
ফেসবুক প্রোফাইলে পতাকার রঙে রাঙ্গালেই যদি প্রতিবাদ করা হয়
কিংবা সাপোর্ট করা হয় তবে আমরা অবশ্যই সেটাকে সমর্থন করি। কিন্তু কেন সেটা সব দেশ ও জাতির
জন্য প্রযোজ্য নয় সেটাই আমাদের প্রশ্ন।সিরিয়া,আফগানস্তান বা ফিলিস্তিনে ইসরাইলকর্তৃক হামলায় হাজার হাজার নারী
পুরুষ ও শিশু মারা গেলে আমরা প্রতিবাদ করতে পারিনা কিন্তু ফ্রান্সের ঘটনায়
প্রতিবাদের নামে নাটক করি।
আজব এক যুগে এসে পড়েছি আমরা যেখানকার মানুষগুলো আজব এবং
তাদের কর্মকান্ডও অদ্ভুত।ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে কোন মূল্যে তারা আইএস
নিধন করবে।অথচ আইএস
এর উত্থান কিন্তু অনেক আগেই হয়েছে এবং তারা সারাবিশ্বে আরো অনেক
দেশে তাদের নির্মম হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে তখন ফ্রান্স ছিল নিষ্কৃয় দর্শক । এই ধরনের মানুষ বাংলাদেশেও
অহরহ দেখা যায়। যাদেরকে আমরা
হুজুগে বাঙ্গালী বলে থাকি।
একদল মানুষ যারা ফ্রান্সের সন্ত্রাসী হামলার পর ফ্রান্সের
পতাকায় নিজেদের ফেসবুক প্রোফাইল রাঙিয়েছে তাদেরই মত একদল একসময়
চাঁদের বুকে সাইদীর ছবি দেখে নিজেদের ফেসবুক প্রোফাইল রাঙিয়েছিল।পৃথিবীর আনাচে কানাচে প্রতিনিয়ত
কোন না কোন সন্ত্রাসী হামলা হচ্ছে। মালয়েশিয়ার বোয়িং বিমান যখন দুইশোর অধিক যাত্রী নিয়ে
আজীবনের মত হারিয়ে গেল তখন কিন্তু আমরা সমব্যাথী হয়ে আমাদের ফেসবুক প্রোফাইল
মালয়েশিয়া বা অন্য কোন দেশের পতাকার রঙে রাঙাইনি।
এখন যুগটাই চলছে এরকম। হঠাৎ কেউ কোন একটা কিছুর প্রচলন
শুরু করে দিলেই সেটা নিয়ে আমরা মাতোয়ারা হয়ে যাই। এই যেমন হঠাৎ করে সেলফী
ভাইরাসের আক্রান্ত হয়ে পড়লে সারা বিশ্ব। অথচ সেলফীর প্রচলনের অনেক
আগেও মানুষ সেফলী তুলতো। তখন হয়তো ওটার নাম সেলফী হয়ে ওঠেনি।
আমরা অবশ্যই ফ্রান্সে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী হামলার
তীব্র নিন্দা জানাই। সেই সাথে আমাদের উচিত পৃথিবীর যে কোন দেশের যে কোন
সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে ঘৃণা করা।আমাদের সংস্কৃতিতে পরিবর্তন
আনতে হবে।আমাদের
একটাই কাম্য “পৃথিবীতে
শান্তি বিরাজ করুক”।
……………………………………………………………………………………………
……………………………………………………………………………………………