পাওয়ার অব আ সেলস ম্যান



মাহবুবের উপর ওর বাবা মা ভীষণ বিরক্ত।বাবা মায়ের খুব স্বপ্ন ছিলো ছেলেটা বিসিএস ক্যাডার হবে,নাম কামাবে কিন্তু ছেলের সেদিকে কোন মন নেই।বিসিএস না হয় নাইবা দিলো কিন্তু এতো কষ্ট করে ডাক্তারী পাশ করার পর সে অন্তত প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে পারতো কিন্তু তাও করবে না।রোজ বাবা মায়ের কথা শুনতে শুনতে একসময় অতিষ্ট হয়ে মাহবুব সোনাকান্দি মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটালে জয়েন করলো।বেসরকারী ক্লিনিক হিসেবে তার বেশ আয়রোজগার হয়।ছাত্রজীবনে সে কানাডার সিটিজেনশীপ পাওয়ার ব্যাপারে আবেদন করেছিল।ভাগ্য ক্রমে সে কানাডা থেকে চিঠি পেয়ে গেলো। শেষে বাবা মাকে বুঝিয়ে কানাডার পথে উড়াল দিলো।বাবা মা তাকে বুঝিয়েছিল দেশে প্রাইভেট ক্লিনিকেতো ভালোই ইনকাম হচ্ছে তাহলে বিদেশে গিয়ে লাভ কি? কিন্তু সে কোন কথাই শোনেনি। তার পর একদিন সে সত্যিই কানাডাতে পাড়ি জমালো।


বাংলাদেশ থেকে ডাক্তারী বিদ্যায় পড়াশোনা শেষ করলেও কানাডাতে সেটার কানাকড়িও মুল্য পেলো না।এর জন্য অবশ্য সে কোন চেষ্টাও করেনি।কয়েকটা পরীক্ষা দিয়ে সরকারের পৃষ্টপোষকতায় সে অনায়াসে ডাক্তার হিসেবে সেখানে কাজ করতে পারতো কিন্তু সে অতো সব ঝক্কি ঝামেলার দিকে যেতে রাজি নয়।কিন্তু বসে বসে খেলে তো রাজার গোলাও শেষ হয়ে যাবে তাই সে ভাবলো কিছু একটা করতেই হবে।নানা দিকে কাজের সন্ধান করতে করতে সে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে সেলসম্যান হিসেবে লোক নেওয়া হবে মর্মে জানতে পেরে স্থির সিদ্ধান্ত নিলো যা থাকে কপালে জীবনতো একটাই একটু পরখ করেই দেখি।এমন ভেবে সে সত্যি সত্যিই সেলসম্যানের কাজটা নিয়ে নিলো।


স্টোরের মালিক মিস্টার রডরিক মানুষ হিসেবে বেশ ভালো।পঞ্চাশের কাছাকাছি তার বয়স।টরেন্টতে যতগুলো বিশাল আকারের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আছে মিস্টার রডরিকেরটা তাদের মধ্যে অন্যতম।জায়ান্ট টাইগার নামে এই বিশাল আকৃতির ডিপার্টমেন্টাল স্টোরটির নামের মধ্যেই এর বিশালত্বের প্রমান বহন করছে।কিপলিং এভিনিউয়ে অবস্থিত এই ডিপার্টমেন্টাল স্টোর গোটা টরেন্টোর মধ্যে সব থেকে বেশি জনপ্রিয়।কাজে যোগ দেওয়ার প্রথম দিন সন্ধ্যায় বরাবরের মতই মিটিং রুমে মাহবুবের ডাক পড়লো।কথাবার্তায় বেশ স্মার্ট হওয়ায় কাজ পেতে তার খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।মিস্টার রডরিক জানতে চাইলেন মেহবুব তুমি কতজন ক্রেতার কাছে পন্য বিক্রি করেছ?রডরিক মাহবুবকে সঠিক ভাবে ডাকতে না পেরে মেহবুব বলে ডাকে। মাহবুব বললো আজতো প্রথম দিন তাই মাত্র একজনের কাছে বিক্রি করেছি।রডরিক খুব অবাক হলেন। তিনি বললেন কি বলছো তুমি? সারাদিনে মাত্র একজনের কাছে বিক্রি করেছ! জায়ান্ট টাইগারের কোন সেলস ম্যান দিনে ৩০ জনের কম ক্রেতার কাছে পন্য বিক্রি করে না আর তুমি কিনা মাত্র একজনের কাছে বিক্রি করেছ! আচ্ছা বলো তুমি কত বিক্রি করেছ?মাহবুবের মুখে হাসি ফুটলো।রডরিক সেটা লক্ষ্য করলেন এবং ভীষণ অবাক হলেন।

তিনি দেখেছেন কোন সেলসম্যান যদি ভালো বিক্রি করতে না পারে তাহলে সে খুব ভীত থাকে,চাকরি থাকবে কি থাকবেনা সেই চিন্তা থাকে কিন্তু মাহবুবের মধ্যে সেরকম কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।তিনি বিষয়টা কি ঘটতে যাচ্ছে তা দেখার অপেক্ষা করতে লাগলেন।এবার মাহবুব বললো আমি ওই এক ক্রেতার কাছে ৯৩ হাজার তিনশো পাউন্ড বিক্রি করেছি! মাহবুবের কথা শুনে রডরিকের মাথায় যেন সাত আসমান ভেঙ্গে পড়লো।তিনি জানতে চাইলেন তুমি কি এমন বিক্রি করেছ যে এতো দাম হয়েছে। এবার মাহবুব কথা বলার সুযোগ পেলো। সে বললো ম্যাকলিন নামে মধ্য বয়সী এক ক্রেতা আসলেন।আমি প্রথমে তার কাছে একটি মাছ ধরার ছোট বড়শী বিক্রি করলাম।তার পর তাকে বললাম আপনি যদি এর সাথে আরো দুটো ছোট বড় বড়শী নেন দেখবেন মাছ পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে গেছে।আমার কথা শুনে তিনি বেশ আগ্রহী হয়ে বললেন তাহলে তাই দাও।আমি তাকে মোট তিনটি বড়শী দিয়ে দিলাম। তিনি বিল পরিশোধ করবেন বলে যখন মনস্থির করতে যাচ্ছেন আমি তাকে বললাম মিস্টার ম্যাকলিন আপনি কিন্তু দুটো জিনিষ নিতে ভুলে গেছেন।তিনি জানতে চাইলেন সেই দুটো জিনিষ কি? আমি বললাম শুধু বড়শী নিলেতো হবে না সাথে একটা বড় ফিসিং রড আর ফিসিং গিয়ারও নিতে পারেন কাজে দিবে।তিনি সাথে সাথে রাজি হলেন।

মাহবুবের কথা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতে লাগলেন রডরিক।তার এক জীবনে এমন অদ্ভুত সেলসম্যান কখনো তিনি দেখেন নি।মাহবুব বললো মিস্টার রডরিক আমি যখন দেখলাম ম্যাকলিন দাম পরিশোধ করতে চাইছেন তখন বিনয়ের সাথে জানতে চাইলাম আপনি কোথায় মাছ ধরবেন বলে মনস্থির করেছেন?তিনি বললেন এখনো স্থির সিদ্ধান্ত নেইনি তবে নোভা স্কটিয়া অথবা সেইন্ট লরেন্স রিভারে যেতে পারি।ম্যাকলিনের কথা শুনে আমি বললাম তাহলেতো আপনার একটা নৌকা প্রয়োজন হবে।ওখানে নৌকা নাও পেতে পারেন।ম্যাকলিন জানতে চাইলেন আমাদের স্টোরে নৌকার ব্যবস্থা আছে কিনা আমি বললাম অবশ্যই।তাকে নিয়ে গেলাম গ্রাউন্ডফ্লোরে বোট স্টোরে।তিনি দেখেশুনে কুড়িফুট লম্বা ডাবল ইঞ্জিনের একটা ইয়ট কিনলেন।কেনার পর তাকে খুব চিন্তিত মনে হলো।

আমি বললাম চিন্তার কোন কারণ নেই।আপনি ভাবছেন এই বিশাল ইয়ট কি করে আপনার ভক্সওয়াগনে করে নিয়ে যাবেন?আপনি চাইলে খুব সহজেই ইয়ট বহনের মত একটা গাড়িও নিতে পারবেন।তিনি পরামর্শটা লুফে নিলেন এবং একটা লরি কিনলেন।এর পর তিনি ক্রেডিট কার্ড বের করলেন দাম পরিশোধ করবেন বলে।আমি বললাম মাছ ধরার জন্য আপনি কোথায় থাকবেন বলে মনে করছেন?বিশেষ করে সেইন্ট লরেন্সের আশেপাশে ভালো কটেজ নেই।সাধারণত ওখানে যারা যায় তারা টেন্ট ব্যবহার করে। আমাদের এখানে ভালো টেন্ট আছে নিতে পারেন।ম্যাকলিন বললেন দেখাওতো কেমন টেন্ট।আমি তাকে টেন্ট হাউসে নিয়ে গিয়ে ছয় সাতজন থাকা যায় এমন একটি টেন্ট কিনতে উদ্বুদ্ধ করলাম।তার পর কাউন্টারে ফিরে এলাম।তিনি আমার হাতে ক্রেডিট কার্ড ধরিয়ে দিলেন।আমি সোয়াইপ করার আগে তাকে বললাম ম্যাকলিন মাছ ধরার ফাকে যখন টেন্টে অবস্থান করবেন তখনতো ক্ষুধা লাগতে পারে বা কিছুটা রিলাক্সে থাকতে ইচ্ছে করতে পারে তাই সেক্ষেত্রে কিছু খাবার আর পানীয় নিতে পারেন।

আমার কাধে হাত রেখে ম্যাকলিন বললেন ইউ আর সো ইন্টেলিজেন্ট। তিনি তখন নিজ হাতে চিপ্স,পনির,বাটার,এমনকি দুই কেস বিয়ার নিলেন।আমি উপহার হিসেবে দোকানের পক্ষ থেকে তাকে আমাদের স্পেশাল ড্রাই স্যান্ডউইচ দিলাম।সব মিলিয়ে তার বিল হলো তিরানব্বই হাজার তিনশত পাউন্ড। এটুকু বলে মাহবুব থেমে গেলো। জায়ান্ট টাইগারের মালিক রডরিক তখন থ! তার মুখে যেন কোন ভাষা নেই।সম্বিত ফিরে পেতে দেরি হলো।তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে মাহবুবকে বললেন যে ক্রেতা মাছ ধরবে বলে একটা ছোট্ট বড়শী কিনতে এসেছিল তার কাছে তুমি এতো কিছু বিক্রি করে ফেললে! কি করে পারলে তুমি? এই বিদ্যা তুমি কোথা থেকে অর্জন করেছ? মাহবুব এবার হো হো করে হেসে দিয়ে বললো রডরিক তুমি ভুল বুঝছো! লোকটা কিন্তু বড়শী কিনতে আসেনি! মাহবুবের কথা শুনে রডরিক আরো অবাক হলো।তিনি জানতে চাইলেন তাহলে কি কিনতে এসেছিল? মাহবুব বললো সে এসেছিল মাথা ব্যাথার ওষুধ কিনতে। আমি তাকে বুঝিয়েছিলাম মাছ ধরলে মাথার যন্ত্রনা সেরে যাবে।

জায়ান্ট টাইগারের বিশাল হলরুমে তখন পিনপতন নিরবতা। সেই নিরবতা ভেঙ্গে রডরিক হো হো হো করে হেসে উঠলো।এক জীবনে এমন বিস্ময়কর কথা তিনি শোনেন নাই।মাথা ব্যাথার ওষুধ কিনতে আসা ক্রেতার কাছে এক পাউন্ড দামের ওষুধ বিক্রির বদলে এই সেলসম্যান তিরানব্বই হাজার পাউন্ডের পন্য বিক্রি করেছে।হাসি থামিয়ে তিনি জানতে চাইলেন আচ্ছা মেহবুব তুমি এর আগে কি কাজ করতে? মাহবুব বললো আমি বাংলাদেশে একটি প্রাইভেট হাসপাতালের ডাক্তার ছিলাম। আমি রোগীদের নানা ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা, ইকো, সি জি, সি টি স্ক্যান, এক্সরে, এম আর আই ইত্যাদি পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিতাম এবং বলে দিতাম কোথায় কোথায় কোন কোন টেষ্ট করানো যাবে।।

রডরিক থ মেরে বসে রইলেন। তার পর বললেন মেহবুব আজ থেকে তুমি আর সেলসম্যান নও। তুমি  বরং এখন থেকে আমার চেয়ারে বসবে আর আমি তোমার দেশে যেয়ে কোন প্রাইভেট হাসপাতালে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে আসবো তার পর বিয়ারের একটা ক্যান খুলে এগিয়ে দিলেন মাহবুবের দিকে।প্রশ্ন করলেন যে দেশের মানুষের সেলসের এতো দক্ষতা সেই দেশতো অনেক উন্নত হওয়ার কথা।মাহবুব কিছু বললো না।চুপ করে থেকে বললো হবে কি করে বলুন? ওখানেই কেউ কেউ অনলাইনে আইফোন ফাইভ দেখিয়ে পার্সেল করে ডিটারজেন্ট পাউডার নয়তো ছোট্ট এক খন্ড ইট!

মাহবুব ওপাশ থেকে কোন উত্তর পেলো না।দেখলো চেয়ারে ঢলে পড়েছে রডরিক। সে বার কয়েক রডরিক রডরিক বলে ডাক দিলো কিন্তু সাড়া পেলো না।যেহেতু সে ডাক্তার তাই বুঝতে পারলে রডরিক জ্ঞান হারিয়েছে।

২৮ এপ্রিল ২০১৪
(কাল্পনিক গালগল্প)