অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসো


--জাজাফী

অফিসে কাজের চাপ বেড়েছে।নতুন প্রজেক্ট নিয়ে কম বেশি সবাই ব্যস্ত।প্রজেক্টটা ভালোভাবে শেষ করতে পারলে কোম্পানীর অনেক লাভ হবে,পাশাপাশি সুনামও হবে।ফারিহা এই প্রজেক্টের একজন মেম্বার হিসেবে চেষ্টা করছে নিজের সেরাটা দিতে।যেন উর্ধতন কর্মকর্তারা ওর পারফর্মেন্স দেখে খুশি হয় এবং ওর ক্যারিয়ারে পজেটিভ প্রভাব পড়ে।অফিস থেকে কোন গাড়ির ব্যবস্থা না থাকায় উত্তরা থেকে মতিঝিল ওকে পাবলিক বাসেই যেতে হয়।রাস্তায় ইদানিং জ্যাম বেড়ে গেছে।এ জন্য যখন বের হওয়ার কথা তার থেকেও এক ঘন্টা আগে বের হয় যেন কোন কারণে অতিরিক্ত জ্যামে আটকা পড়ে অফিসে দেরি হয়ে না যায়।প্রয়োজনে সময়ের চেয়ে একটু আগে পৌছে না হয় অপেক্ষা করবে সেটাও ভালো।প্রথম প্রথম অফিসে মানিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছিল বিশেষ করে এতোটা পথ বাসে যাতায়াত করা ছিল রীতিমত কঠিন।কিন্তু কদিন যেতে না যেতেই রাস্তার হালহাকিকত বুঝে ফেলায় এখন আর ওর খুব একটা সমস্যা হয় না।সেদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হচ্ছিল ফারিহা।একমাত্র ছোট ভাই নুহানের রুমের পাশ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ মনে হলো ধোয়া উড়ছে।বিষয়টা কি জানার জন্য দরজা ঠেলে উকি দিতেই সে যা দেখলো তাতে তার মনটাই খারাপ হয়ে গেলো।

নুহান ওর একমাত্র ছোট ভাই।এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে।ছোট বেলা থেকেও মায়ের আদরের চেয়ে বোনের আদরেই সে বেড়ে উঠেছে তাই ফারিহার কাছে ছোট ভাই হলো নয়নমনি।কিন্তু ফারিহার মনটা খারাপ হয়ে গেল যখন দেখলো আদরের ছোট ভাই সিগারেটের নেশায় পড়েছে।দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে নুহান বলে ডাক দিতেই নুহানের মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।রেড হ্যান্ড কট বলে যে কথাটি আছে সে আজ সেই সময়ে অবস্থান করছে।বোনের সামনে সিগারেট সহ হাতেনাতে সে ধরা পড়েছে।না পারছে সিগারেট ফেলতে না পারছে লুকাতে।ফারিহা একমাত্র ভাইয়ের ভীত অবস্থা দেখে কিছুটা মায়া হলো।মনে মনে ভেবেছিল আজ ওকে খুব বকবে কিন্তু এখন আর সেটা হচ্ছেনা।ভাইয়ের হাত থেকে জ্বলন্ত সিগারেটা নিয়ে নিলো।বিছানার উপর তখন পুরো এক প্যাকেট সিগারেট পড়েই ছিল।প্যাকেটটা তুলে নিয়ে ব্যাগে রাখলো ফারিহা।উদ্দেশ্য হলো অফিসে যাবার পথে জসীমউদ্দীন মোড়ে যে ডাস্টবিন আছে ওখানে ফেলে দেবে।জ্বলন্ত সিগারেটটা নিভিয়ে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিতে দিতে বললো খবরদার আর যদি সিগারেট দেখি তবে শাস্তির ব্যবস্থা আছে।আদরের ভাইকে যে সে শাস্তি দিতে পারবেনা তা সে নিজেও জানে অন্যদিকে নুহান ভাবে কী শাস্তি দিবে কে জানে।সে চুপ করে না থেকে মাথা নেড়ে সায় দিলো।

ফ্রেন্ডস ক্লাবের সামনে গিয়ে দাড়াতেই খালি রিকশা পেয়ে গেল।দশ টাকা ভাড়া দিয়ে সোজা রাজলক্ষ্মী গিয়ে নামলো।ওখান থেকে ওভারব্রিজ পার হয়ে পুর্ব পাশে গিয়ে বাসের জন্য আর অপেক্ষা করতে হলো না।দেখলো কয়েকটা বাস তখন যাত্রী ওঠানামা করছে।তারই একটিতে উঠলো।ভাগ্য ভালো ছিল তাই বাসে সিটও পেয়ে গেল।ফারিহা বসে বসে অফিসের প্রজেক্ট নিয়ে ভাবতে লাগলো।সময় গড়িয়ে যাচ্ছে।এ কদিনে ঠিক কতটা সুন্দর ভাবে প্রজেক্ট শেষ হবে তা জানা নেই।হয়তো আরো বেশি সময় দিতে হবে যেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করা যায়।বাস চলছে তার আপন গতিতে।ক্ষণে ক্ষণে থামছে আর যাত্রী ওঠা নামা চলছে।যাত্রা পথে কত ধরনের মানুষ যে দেখা যায় তার হিসাব নেই।নানান রকম মানুষ নানান রকম পেশা।খিলক্ষেত পার হতেই বাসের কন্ডাক্টর এসে ভাড়া চাইলো।ফারিহা ব্যাগ খুলে ছোট্ট পার্স বের করে ভাড়া পরিশোধ করতে গেল।পার্স বের করতে গিয়ে ব্যাগ থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা নিচেয় পড়লো।ঠিক তখন তার মনে পড়লো প্যাকেটটা ডাস্টবিনে ফেলা হয়নি!

এদিকে অন্য ছেলে বুড়ো যারা কাছাকাছি ছিল তারা দেখলো ওর ব্যাগ থেকে সিগারেটের প্যাকেট পড়েছে।আশে পাশের মানুষের ভ্রু কুচকে তাকালো। মধ্য বয়ষ্ক একজন বলেই বসল "কি যুগ পড়ল মেয়েরাও ব্যাগে সিগারেট নিয়ে ঘোরে।লোকটার কথায় ফারিহার কোন ভাবান্তর হলো না।সে সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে আবার ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো।এখন জানালা দিয়ে বাইরে ফেলা ঠিক হবে না।তাহলে কারো না কারো হাতে পড়বে এবং সে নিশ্চই সিগারেট খাবে।তাছাড়া লোকে হয়তো ভাববে দেখে ফেলেছে বলে সে সিগারেট ফেলে দিয়েছে।ফারিহা খুব শক্ত মেয়ে।সে ছোট বেলা থেকেই খুব প্র্যাকটিক্যাল।পাছে লোকে কিছু বলে কথাটার সাথে সে পরিচিত এবং এসব সে কানে তোলে না।কে কি বললো তাতে তার কিছু যায় আসে না।ফারিহা জানে সে কেমন এবং তাই অন্যরা কি বললো না বললো তা কোন ব্যাপার না।লোকগুলো শুধু ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকলো। তারা জানতেও পারলো না অফিসে আসার সময় ফারিহার ব্যাগে সিগারেট কিভাবে ঢুকলো।

সেদিন বাসায় ফেরার পর নুহানকে সে কিছু বলেনি।যেন কিছু ঘটেনি।নুহান অবশ্য রাতের খাবারের সময় বোনের সামনের চেয়ারে বসতে গিয়ে কিছুটা লজ্জা পেয়েছে।তবে ভাই বোনের মধ্যে দারুন বন্ধুত্ব থাকায় সে খেতে খেতে বললো আপু স্যরি। আর কখনো সিগারেট খাবো না।ফারিহা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসি দিলো।তার পর খেতে খেতে অনেক গল্প হলো।বেশিরভাগই নুহানের বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প।এক সপ্তাহ পর ফারিহাদের প্রজেক্টটা শেষ হলো।ওরা যতটা আশা করেছিল তার চেয়েও ভালো ফলাফল পেলো।অফিসের সবাই বেশ খুশি।দারুন কাজ করায় অফিস খুশি হয়ে বেশ কয়েকজনকে প্রমোশান লেটার দিলো।সেই ভাগ্যবানদের মধ্যে ফারিহাও ছিল।খুশির সংবাদটা সবার আগে বাবাকে জানানো দরকার।কিন্তু দেখা গেলো বাবার ফোনে সংযোগ পাওয়া যাচ্ছেনা।একমাত্র ছোটভাই নুহানকেও জানানো দরকার।ফোন করতেই নুহানের কন্ঠ ভেসে আসলো।ফারিহা খুশি খুশি গলায় বললো জানিস আমার প্রমোশান হয়েছে।

আপুর প্রোমোশান হয়েছে শুনে নুহানের খুবই ভালো লাগলো।ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বোনকে অভিনন্দন জানালো।বোনকে চমকে দেবে বলে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরলো।রাজলক্ষ্মী নেমে দোকান থেকে দুটো গোলাপ কিনে বোনের ফেরার অপেক্ষায় থাকলো।বোনের অফিস ছুটি হওয়ার পর বার কয়েক ফোন করে জেনে নিলো এখন কত দূরে।এয়ারপোর্ট পার হওয়ার পর ফারিহা নিজেই ফোনে জানালো আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে রাজলক্ষ্মী এসে নামবে।নুহান মনে মনে ভাবতে থাকে সবার আগে সামনে থেকে বোনকে সেই প্রথম অভিনন্দন জানাবে।বোন নিশ্চই অনেক খুশি হবে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ফারিহা চলে এলো।সত্যি সত্যিই সে কল্পনাও করেনি তার জন্য নুহান ফুল নিয়ে অপেক্ষা করছে।বোন সামনে আসতেই ফুলগুলো বাড়িয়ে দিয়ে অভিনন্দন জানালো।রমিজ মিয়ার চায়ের দোকানে তখন অনেক মানুষ চা খাচ্ছে।কেউ কেউ দেখছিল ওদেরকে।নুহান যখন ফুল দিয়ে বোনকে শুভেচ্ছা জানালো তখন দু একজন মন্তব্যও করে বসলো।ওদের কানেও সেই সব কথা ভেসে আসলো।একজন তার পাশের লোককে বললো দেখেছেন ওদেরকে মানিয়েছে বেশ।শুনে নুহানের মেজাজ গরম হয়ে গেল।কিন্তু ফারিহা ওকে শান্ত রাখলো।সে জানে এসব মানুষের সাথে রিঅ্যাক্ট করে কোন লাভ নেই।যারা অন্ধকারে থাকতে চায় তারা আজীবন অন্ধকারেই থাকুক।জোর করে আলোতে বের করে আনার কোন মানে হয় না।ওরা যখন দুই ভাই বোন একটা রিকশায় উঠলো তখনো কিছু চোখ ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল।মনে মনে কত কিছুইনা তারা ভাবছিল।ফারিহা ওসবে পাত্তা দেয়না।সেতো জানে সে কি এবং তাদের নিয়ে কে কি বললো তাতে তার বয়েই গেছে।ওর বরং দুঃখ হলো লোক গুলো জানতেও পারলো না এক ছোট ভাই তার নিজের বোনের সাফল্যে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছে।

জীবন জীবনের মতই চলতে থাকে।এই সুখ আবার এই দুঃখ।অনেকটা আকাশের মত।সকালে ঝকঝকে নীল আকাশ সন্ধ্যা নামার আগেই হয়তো কালো মেঘে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।মানুষের জীবনেও হাসি আনন্দ আসে নানা সময়ে।নুহান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে নিজের রুমে শুয়ে ছিল।সেদিন ওর মনটা খুব একটা ভালো নেই।বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে তাই আর বাইরে যাওয়া হয়নি,বিকেলের নাস্তাও খাওয়া হয়নি।সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে ফারিহা দেখলো নুহান মন মরা হয়ে বসে আছে।ভাইয়ের পাশে বসে আদুরে গলায় জানতে চাইলো আমার রাজপুত্র ভাইটির মন খারাপ কেন?নুহান তখন জানালো ওর এক বন্ধুর ক্যান্সার হয়েছে।শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।দেখলে খুব মায়া হয়।কতদিন বাচবে কেউ জানেনা।

বন্ধুর জন্য নুহানের এই মায়া দেখে ফারিহারও খুব মায়া হলো।ভাইয়ের চুলে বিলি কেটে দিয়ে বললো মানুষের জীবন হাসি আনন্দ বেদনার।কখন কাকে চলে যেতে হয় কে জানে।এ নিয়ে দুঃখ করে লাভ কী?নুহান বললো ওর ক্যান্সার হয়েছে এটার জন্য যতটা না মন খারাপ হয়েছে তার চেয়ে বেশি মনখারাপ হয়েছে একদল মানুষের কথা শুনে।মধুর ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে ওকে নিয়ে শাহবাগ আজিজ সুপারমার্কেটে যাচ্ছিলো এমন সময় পাশ দিয়ে যেতে যেতে দুজন মুরব্বী মত মানুষ বলছিল ছেলেটার চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখেছ?কেমন নেশাখোর মনে হচ্ছে।নেশা না করলে কি আর চেহারার এই হাল হয়।আজকালকার ছেলেপুলে সব গোল্লায় গেছে।কথাগুলো খুব কষ্ট দিয়েছে নুহানকে।ইচ্ছে করেছিল দু ঘা লাগিয়ে দিতে কিন্তু বড় আপুর মতই ক্যান্সার আক্রান্ত বন্ধুটিও খুব শান্ত।সে বললো থাক,যে যা বলে বলুক তাতে তো আমাদের কোন ক্ষতি নেই।আমরা বরং এটা বলতে পারবো লোকগুলো আলোর মুখ দেখলো না।ক্যান্সার আক্রান্ত এক রোগীকে যারা নেশাখোর মনে করে বসে আছে তারা আলোর মুখ দেখবে কি করে।তাদেরকে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আনার মত কেউ নেই।

নুহানের মুখের দিকে তাকিয়ে ফারিহা তখন ওকে শান্তনা দিতে দিতে একটা গল্প বলে।এক ভদ্রমহিলা একটা ঘরোয়া পার্টিতে গিয়েছিল।বছরখানেক আগে তার একমাত্র ছেলে রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিল।সেই দুঃখ তার হৃদয়ে আজীবন থেকে যাবে যা অন্য কেউ বুঝতে পারবে না।পার্টিতে যাওয়ার সময় মহিলা যতটা সম্ভব পরিপাটি হয়ে সেজেছিল।পার্টিগুলোতে নানা রকম মানুষ আসে।বিশেষ করে ইদানিংকালে টিভিতে সিরিয়াল দেখা মহিলার সংখ্যাও কম নয়।তারা যত বেশি পারে কানকথা লাগায়।সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি।মহিলা সাজের সাথে হাল্কা লিপিস্টিকও লাগিয়েছিল।সেটা দেখে কেউ কেউ টিপ্পনী কেটে মন্তব্য করলো "শখ কি রে বাবা। ছেলেটা মারা গেছে এক বছরও হয়নি অথচ তিনি এসেছেন লিপস্টিক ঠোঁটে লাগিয়ে!"
অথচ সেই সব মহিলারা কেউ জানেনা সেদিনই ছিল মহিলাটির সেই ছেলের জন্মদিন॥ পার্টিতে আসার আগে মা ছেলের ডায়েরি বুকে জড়িয়ে অঝোরে কেঁদে এসেছেন। ডায়রিতে যেখানে লেখা ছিলো
"আমার মা খুব সুন্দর,সাজলে মাকে অত্যন্ত সুন্দরী লাগে যেন রুপকথার রাজরানী সে,আজ আমার জন্মদিন! কিন্তু আমার মা আজ একটুও সাজেনি। না আমার জন্মদিনে মা না সাজলে ভালো লাগেনা আমার "

বোনের মুখে এই গল্প শুনে নুহান স্তব্ধ হয়ে গেল।আর ভাবতে লাগলো মানুষ কী করে এতোটা অন্ধকারে থাকতে পারে।কোন কিছু না জেনে কেমন করে মানুষ যা খুশি ভেবে নিতে পারে।ওর খুব ইচ্ছে করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে এ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে বলবে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসো।


--জাজাফী
১ নভেম্বর ২০১৪




কোন মন্তব্য নেই: