লেখা নিয়ে লেখা






বই মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু। ওমর খৈয়াম তাই লিখেছিলেন রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে,প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হবে। বই তবু রবে অনন্ত যৌবনা।আর বাংলা ভাষায় চলিত রীতির প্রবর্তক প্রমথ চৌধুরী বলেছেন বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয়না। বাংলা সাহিত্য এখন রীতিমত সমৃদ্ধ বলা চলে। ১৯০৭ সালে চর্যাপদ আবিস্কারের মধ্য দিয়ে হয়তো বাংলা সাহিত্যের যাত্রা শুরু তবে সেটা বর্তমানে উৎকর্ষতার দিক থেকে অন্যান্য ভাষার সাহিত্যকে ছাড়িয়ে গেছে। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্তি বিশ্ব দরবারে বাংলা সাহিত্যকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে নব রূপে। পৃথিবীর অনেক ভাষা আছে যে ভাষার বয়স বাংলা ভাষার চেয়ে অনেক বেশি কিন্তু সাহিত্য রচনার দিক থেকে তারা যোজোন যোজন ব্যাবধানে রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ভাষা হিন্দি। 

হিন্দি ভাষায়ও কম বেশি রচিত হয়েছে অনেক কাব্য মহাকাব্য কিন্তু এখনো সে ভাষার কেউ নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়নি। আমাদের আছে রবীন্দ্রনাথ,নজরুল জীবনানন্দ থেকে শুরু করে মাইকেল মধুসুদন দত্ত। আমাদের আছে জসীম উদদীন,শামছুর রাহমান,আল মাহমুদ হয়ে হালের চির তরুণ কবি নির্মলেন্দু গুণ। কবিতার মায়া জাল বিছিয়ে আমাদের মুগ্ধ করে রেখেছেন বুদ্ধদেব বসু,বিনয় মজুমদার সহ আরো অনেকেই। বাংলা সাহিত্যের রয়েছে আলাদা একটি বৈশিষ্ট্য। আমাদের ভালবাসায় গড়ে উঠেছে বইমেলা। প্রতি বছর বইমেলার দিকে তাকালেই বিষয়টা আমাদের বোধগম্য হবে বলে আশা করি। 

প্রতি বছরই একুশে বইমেলায় বের হচ্ছে পাঁচ হাজারের অধিক নতুন বই। এর মধ্যে সিংহ ভাগ লেখক কবিই নতুন। এভাবে সঠিক পরিসংখ্যন হয়তো আমাদের হাতে নেই তবে বিগত কয়েক দশকে আমাদের সাহিত্যে যোগ হয়েছে কয়েক মিলিয়ন নতুন বই।কিন্তু প্রতি বছর যে পরিমান নতুন বই বের হচ্ছে তার সব কি পাঠযোগ্য? কিংবা যে লেখকেরা নতুন নতুন বই নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হচ্ছেন তারা সবাইকি টিকে আছেন? কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছেন তাদের অনেকেই।বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখকদের জীবনীর দিকে তাকালেই দেখা যাবে তাদের রচিত সাহিত্য সংখ্যা হাতে গোনা। কিন্তু তারা সমাসীন উচু আসনে। তাদের রচিত সাহিত্যের কদর বিশ্বব্যাপী।

একজন মানুষের পক্ষে কত গুলো বই পড়া সম্ভব? জীবনে অবসরেরই আজ বড় অভাব তাই আমরা হয়তো আজ খুব কম মানুষই আছি যারা বই খুলে অন্য ভূবনে ডুব দিতে পারি। ফেসবুক,টুইটারের যুগে এখন সবাই সময় কাটায় সোশ্যাল মিডিয়াতে। প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন বই মনের চোখ বাড়ায়। আমাদের এ যুগে মনে হয় কারো সেই চোখের দরকার নেই। কিন্তু তারপরও যারা সাহিত্যের ভূবনে হারিয়ে যেতে চান। যারা ওরান পামুক,গার্সিয়া মার্কেজ,ড্যান ব্রাউন থেকে শুরু করে আল মাহমুদ,শামছুর রাহমান কিংবা নির্মলেন্দু গুণে মুগ্ধ তাদের সংখ্যাও কিন্তু একেবারে কম নয়। হুমায়ুন আহমেদেইতো মজে আছে এ দেশের কোটি কোটি তরুন তরুনী।কত জন হিমু হতে চেয়েছে তার কোন সীমা নেই। এই লেখাটি তাদের জন্যই।

লেখা নিয়ে লেখা এই শিরোনামটি আদতে ধারকরা। বর্তমান বাংলাদেশের জনপ্রিয় সাহিত্যিক আনিসুল হকের একটা বই আছে লেখা নিয়ে লেখা শিরোনামে। প্রতি বছর যে হারে বই প্রকাশ পাচ্ছে তার মধ্যে সেরা বই গুলি বাছাই করে পড়া আমাদের অনেকের পক্ষেই অসম্ভব। বাংলা সাহিত্যের দিকপাল কবি ও সাহিত্যিকের লেখা গুলো পড়তে গেলেই আমাদের আরো দুই তিনবার জন্ম নিতে হবে সেখানে নতুনদের লেখা পড়াতো বাদই থাকলো। সেই অসাধারণ কাজটিই করেছেন সুলেখক আনিসুল হক। তিনি লেখা নিয়ে লেখা বইটিতে তুলে ধরেছেন এদেশের কবি ও সাহিত্যিকদের সেরা বই ও লেখা গুলো। বইটির প্রতিটি পাতা আপনাকে বিমোহিত করবে আটকে রাখবে সেটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত। বাদ পড়েনি মানিকবন্দ্যোপাধ্যয় থেকে শুরু করে হাসান আজিজুল হক। সেলিনা হোসন,আব্দুল মান্নান সৈয়দ থেকে শুরু করে শামছুর রাহমান আছেন বইয়ের পাতায় পাতায়। আল মাহমুদের কবি হয়ে ওঠা কিংবা নির্মলেন্দুগুণের হুলিয়া থেকে শুরু করে স্থান পেয়েছে শামছুর রাহমানের আসাদের শার্ট। উঠে এসেছে শহীদুল জহিরের কথা আছে অতসীমামী নিয়ে সুন্দর আলোচনা।

 আধুনিকতা,উত্তর-আধুনিকতা ও নজরুল থেকে প্রধান কবির প্রেম গাথা।আধুনিকতার শেষ প্রান্ত এবং আবিদ আনোয়ারের কবিতা যেখানে স্থান পেয়েছে। উঠে এসেছে টোকন ঠাকুর এবং হুমায়ুন রেজার কবি হয়ে ওঠার চিত্র। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং দেবেশ রায় যেখানে বার বার ফিরে এসেছেন তাদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে। আলালের ঘরের দুলাল কিংবা হুতোম প্যাচার নকশা যেখানে তুলনীয় হয়ে উঠেছে বিশ্বের সেরা সাহিত্যের সাথে। খোয়াব নামা কিংবা তিস্তা পারের বৃত্তান্তকে দেখানো হয়েছে বিশ্ব সাহিত্যের অবিস্মরণীয় উপন্যাসের তালিকার শীর্ষে যেখানে আছে গ্যাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ,নগীব মাহফুজ এবং গুন্টার গ্রাসের মত শ্রেষ্ঠ লেখকেরা। নোবেল পুরস্কারের ভাষনে মার্কেজ সাহিত্য নিয়ে কি বলেছিলেন সেটাও টেনে আনা হয়েছে। বাহুল্যবর্জিত এবং অসাধারণ কথামালা সাজিয়ে লেখক চিনিয়েছেন শ্রেষ্ঠ সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের। 

শুধু মাত্র এই একটি বই পড়লেই বাংলা সাহিত্যের দিকপাল কবি ও সাহিত্যিকদের রচনা সম্পর্কে সাম্যক ধারণা পাওয়া যাবে যা একজন পাঠককে সুপাঠ্য খুজে পেতে সাহায্য করবে।আমি লেখা নিয়ে লেখা বইটি রচনার জন্য ধন্যবাদ দিতে চাই সুলেখক আনিসুল হককে। তার এই বইটি আমাদের মত পাঠকদের সেরা রচনা গুলো বেছে নিতে অনেকটাই সাহায্য করেছে। হুমায়ুন আজাদের লাল নীল দীপাবলি যদি হয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস তবে আনিসুল হকের লেখা নিয়ে লেখা বইটি অবশ্যই বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ট বইগুলোর পরিচয়দানকারী বলে বিবেচিত হতে বাধ্য। বইয়ে লেখক অসাধারণ পান্ডিত্য দেখিয়েছেন। কোথাও কোথাও আহমদ ছফার বয়ানে সরাসরি তুলে ধরেছেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে। বইটি তাই হয়ে উঠেছে একটি সাহিত্যপরিচয়দানকারী স্বর্ণখন্ড রুপে। 

শুধু কয়েক ছত্র লিখে সেটা বই আকারে প্রকাশ করলেই যে সাহিত্য হয়না কিংবা সাহিত্যের ভান্ডার সমৃদ্ধ করা যায়না তা এ বইয়ে লেখক যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছেন। আমাদের বাংলা সাহিত্যে যেমন জন্মেছিলেন সুকুমার রায়,সত্যজিৎরায় তেমনি এখনো লিখে চলেছেন অনেকেই। তাদের মধ্যে কারো কারো লেখা চিরকালীন সাহিত্যের মর্যাদা পেয়ে গেছে আর কেউ কেউ হারিয়ে যাচ্ছে কালের গভীরে। লেখক দেখিয়েছেন আমাদের লেখকদের অনেকের রচনাই সাহিত্যরসে ভরপুর এবং কোন কোনটা বিশ্ব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠত্বেরও দাবীদার। জীবনানন্দের বনলতা সেন কিংবা নির্মলেন্দু গুনের হুলিয়া থেকে শুরু করে শামছুর রাহমানের আসাদের শার্ট সব গুলোই আমাদের অন্তরে প্রশান্তি এনে দিয়েছে। 

প্রতি বছর কত সংখ্যক নতুন বই বের হলো আর কত সংখ্যক নতুন লেখকের আবির্ভাব হলো সেটা পরিসংখ্যনের খাতাতেই পড়ে থাক। আপাতত আমরা লেখা নিয়ে লেখা বইয়ে তুলে ধরা বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সব রচনাগুলোর সাহিত্য রসে অবগাহন করে আসি। তখন বুঝতে কারো বাকি থাকবেনা বাংলা সাহিত্য কতটা সমৃদ্ধ আর কতটা মধুর। এ সাহিত্যকেই আমাদের বিশ্ব দরবারে পৌছে দিতে হবে। যেন বিশ্ববাসী সেটা পড়ে বুঝতে পারে শুধু একজন রবীন্দ্রনাথই নয় আমাদের সাহিত্যে আরো অনেক দিকপাল সাহিত্যিক রচনা করে গেছেন এমন সব সাহিত্য কর্ম যা বিশ্বের অন্যান্য ভাষার সাহিত্য থেকে এগিয়ে আছে যোজন যোজন ব্যবধানে।
 

এস এম হল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


কোন মন্তব্য নেই: