মিথ্যার উপর ভিত্তি করে দাড়িয়ে আছি আমরা

ইফতার পার্টিতে দাওয়াত পেয়েছে তানিশা আপু আর তার স্বামী।টেবিলে সাজানো আছে হরেক রকম জুস,শরবত এবং অন্যান্য খাবার।যে কেউ ইচ্ছা মত খেতে পারবে।তানিশা আপু আর তার স্বামী বেছে নিলেন পেস্তা বাদামের শরবত।অন্য গুলোর তুলনায় এটার দাম বেশি।নিজেদের যে সামান্য আয় তা দিয়ে পেস্তাবাদামের শরবত কিনে খাওয়ার কথা তখন তারা চিন্তাই করতে পারেনা। তানিশা আপুদের মত অনেকেই পেস্তাবাদামের শরবতই নিলেন। কিন্তু ইফতারির পর খাওয়ার সময় সবাই দেখা গেল বমি করে উগরে দিচ্ছে।বিষয়টা কি সেটা জানার জন্য যে শরবত বানিয়েছিল তাকে ডেকে এনে কিভাবে এই শরবত বানিয়েছে তা জানতে চাওয়া হলো। সে জানালো বাজারে পেস্তাবাদামের যে দাম তাতে তা দিয়ে শরবত বানানো খুবই কঠিন।টাকাও ছিলনা অত তাই বুদ্ধি করে সহজেই পেস্তাবাদামের শরবত বানিয়েছি। সবাই অবাক হয়ে জানতে চাইলো তা বুদ্ধিটা কি?তখন সে জানালো লাক্স সাবানে আছে পেস্তাবাদাম আর ডাব সাবানে আছে দুধ। তাই খুব কম টাকায় দুটো লাক্স সাবান আর দুটো ডাব সাবান কিনে সেটা গুলিয়েই শরবত বানিয়েছি। হয়ে গেছে পেস্তাবাদামের শরবত! 

সবাই যখন ওকে এক হাত দেখে নিতে যাবে তখন দাদা ভাই সবাইকে থামি দিয়ে বললো ওর আর দোষ কি বলো? দেখ কি দিন এসে গেল যে খাবার তৈরি হয় বিষাক্ত জিনিষ দিয়ে আর সাবান তৈরি হয় ফলমুল শাক সবজি দিয়ে।
দুবছরে তানিশা আপুর স্বামীর বেতন বেড়েছে মোটামুটি। কিছু টাকাও জমিয়েছে সে। একদিন তানিশা আপু তার স্বামীকে ফোন করে বললো ওগো শুনছো আমাকে কিছু টাকা দেওয়া যাবে আমি না স্পা নেব।তানিশা আপুর স্বামী বললেন এ আর এমন কি? কতটাকা লাগবে বলো।আপুর যেন খুশি আর ধরেনা।খুশিতে গদগদ হয়ে বললো বেশি না মাত্র এক লাখ টাকা।তাহমিদ ভাইয়া চুপ হয়ে গেলেন। তিনি চিন্তা করে দেখলেন সামান্য স্পা নিতে এক লাখ টাকা লাগবে?এই ঢাকা শহরে অন্তত কয়েক লক্ষ মানুষ আছে যাদেরকে এক লাখ টাকা দিলে বিশ বছর খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারবে কারণ তারা কেউ কেউ দিন একবার খায় আবার কেউ কেউ দুই দিনে একবার খায়।চুপ থাকতে দেখে তানিশা আপু জানতে চাইলেন কি হলো দিবা টাকাটা? তাহমিদ ভাইয়া গলা খাকারি দিয়ে বললেন চিন্তা করোনা জানটুশ আমি তোমার জন্য স্পা নিয়ে আসতেছি।এটা শুনে তানিশা আপু যেন দুনিয়াতে বসেই স্বর্গ হাতে পেলেন।
অন্যরা যেখানে পার্লারে গিয়ে স্পা নেয় সেখানে তার স্বামী তার জন্য বাসায় নিয়ে আসছে এটা সত্যিই অকল্পনীয়। 

সে সাথে সাথে তার বান্ধবীদেরকে ফোন করে সব জানালো।অন্যরা সব শুনে তারা সবাই ঈর্ষান্বিত হলো। তানিশা আপু এই খুশিতে তাহমিদ ভাইয়ার জন্য তার পছন্দ মত সব খাবার রান্না করলেন। বাসায় ফিরে তাহমিদ ভাইয়া দেখলেন এলাহী কান্ড।খাবার টেবিলে নানা পদের খাবার।সে খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুললো। তানিশা আপু তখন স্বামীকে স্পার কথাটা মনে করিয়ে দিলেন। তাহমিদ ভাইয়া বললেন আরে আমিকি আর ওটার কথা ভুলি।আমি অবশ্যই তোমার জন্য স্পা নিয়ে এসেছি।তানিশা আপু এখানে সেখানে খুজেও স্পা পেলো না।ঠিক তখন তাহমিদ ভাইয়া তার হাতে একটি পানির বোতল ধরিয়ে দিলেন যার নাম স্পা!তানিশা আপু মেজাজ খারাপ করে শোবার ঘরে চলে গেল।

পরদিন সকালে ভাইয়া অফিসে চলে গেলে তানিশা আপু সবে মাত্র সোফাতে আরাম করে বসেছে ঠিক তখন দরজায় নক করলো।দরজা খুলেতেই দেখা গেল একটা বিশ বাইশ বছরের ছেলে হাসি মুখে দাড়িয়ে আছে। সে বললো ম্যাডাম আমি এসেছি স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেড থেকে। আচ্ছা ম্যাডাম মনে করে দেখুনতো শেষ কবে দুধ দিয়ে গোসল করেছেন? এক কথা শোনার সাথে সাথে আগের রাতের রাগ উসকে উঠলো তানিশা আপুর মনে। সে ঝেটিয়ে বিদায় করলো লোকটাকে। আর বললো মশকরার জায়গা পায়না লোকজন।দুধ দিয়ে গোসল করাতে এসেছে। যে দেশের সিংহভাগ মানুষ দিনে দু বেলা পেট ভরে ডাল ভাতই খেতে পারেনা সেখানে দুধ দিয়ে গোলস করানোর রসিকতা করতে এসেছে। 

ওদিকে তাহমিদ ভাইয়া অফিস শেষে গেলেন একটা সিমেন্টের দোকানে।তার অনেক দিন থেকেই ভুল হচ্ছে সিমেন্ট কেনার কথা কিন্তু কেনা হচ্ছেনা। তিনি বেশ ভাল একটা দোকানে গিয়ে বললেন আপনাদের এখানে কোন কোন ব্রান্ডের সিমেন্ট আছে? আমাকে একটু দেখান।দোকানদার বিশাল বড় কাস্টমার পেয়ে খুশিতে আটখানা হয়ে গেলেন।কাজের ছেলেটিকে বলে চা বিস্কুট আনালেন সাথে কোল্ড ড্রিংসও আনালেন। তাহমিদ ভাইয়া তাদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে বললেন আরে না না এসবের কোন দরকার নেই। দোকানদার বললেন না বলছেন কেন অবশ্যই আপ্যায়নের দরকার আছে।দোকানের কর্মচারি একটা ছোট পলিথিনে কয়েক পদের সিমেন্ট এনে রাখলেন।দোকানী এবার জানতে চাইলেন তা বলুন আপনার কত বস্তা সিমেন্ট লাগবে আর কবে লাগবে। তাহমিদ ভাইয়া অবাক হয়ে বললেন কি বলছেন মশাই! কত শত বস্তা লাগতে যাবে কেন? আমার এই বিশ ত্রিশটাকার সিমেন্ট হলেই চলবে।বাসায় ফ্রিজ নেই তাই পানি ঠান্ডা রাখার জন্য একটা মাটির কলসি কিনেছিলাম। সেটাতে একটা ফুটো দেখা দিয়েছে। সেটা সারবো বলেই একটু সিমেন্ট নিতে বলেছে আমার স্ত্রী।সব শোনার পর দোকানীর মুখটা কালো হয়ে গেল। 

বাসায় ফিরে কলিংবেল চাপতেই তানিশা আপু দরজা খুলে দিল। তার হাতে তখন একটা ঝাটা। সেটা দেখে ভাইয়া বললেন কি ব্যাপার গত রাতের রাগ কমেনি এখনো?আমাকে কি ঝাটাপেটা করবা নাকি?তানিশা আপু লজ্জায় পড়ে গেলেন।ঠিক তখন তাহমিদ ভাইয়া বললেন এখন থেকে রোজ তুমি দুধ দিয়ে গোসল করতে পারবা!!কথাটা শুনেই তানিশা আপু থম করে দাড়িয়ে গেলেন।ভাইয়া তখন ব্যাগ থেকে একটা মেরিল সাবান বের করে দিলেন সেখানে লেখা মেরিল মিল্ক সোপ।দুধ দিয়ে গোসলের অনুভূতি। এটা দেখে তানিশা আপু একচোট হেসে নিলেন।ভাইয়া বিষয়টা বুঝতেই পারলেন না যে সকালে এক ব্রান্ডপ্রোমোটারকে এই কারণে আপু ঝাটাপিটা করে তাড়িয়েছে।

মিথ্যার উপর ভিত্তি করে চলছে আমাদের জীবন। চলুন একটা গল্প শুনি

রাসেলের পরীক্ষা শুরু হতে বেশিদিন বাকি নেই কিন্তু সে ঠিকমত পড়তেই বসছে না। এক সকালে বাবা তাকে ডেকে বললেন তুমি যদি এখনি পড়তে বাসো এবং তিন ঘন্টা মন দিয়ে পড়ো আর এভাবে এক মাস পড়তে পারো তবে তোমাকে আমি আইফোন সিক্স কিনে দেব। এটা শুনে রাসেল চলে গেল। সে নিয়মিত তিন ঘন্টা করে পড়া শেষ করে বাবাকে বলতো বাবা পড়া শেষকরেছি। এক মাস যেদিন পুর্ন হয়ে গেল সেদিন সে বাবার সামনেগিয়ে দাড়াল। বললো বাবা আমি এই মাত্র তিন ঘন্টা পড়া শেষ করে এসেছি এখন আমাকে আইফোন সিক্স কিনে দাও। বাবা বললেন আমি মিথ্যা বলেছিলাম। রাসেল তখন বললো বাবা জানো আম গাছে কখনো কাঠাল ধরেনা!বাবা বিষয়টা বুঝতে না পেরে জানতে চাইলেন এর মানে কি? রাসেল যেতে যেতে বললো বাবা আমিও মিথ্যা বলেছিলাম। আমিও রোজ তিন ঘন্টা পড়িনি!
বিজ্ঞাপনে হরহামেশাই মিথ্যা কথা বলে বলে আমাদেরকে আজেবাজে পন্য ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমরা সেগুলো নির্দ্বিধায় ব্যবহার করছি।বিজ্ঞাপনের নামে যে অপসংস্কৃতি এ দেশে চালু হয়েছে তা বন্ধ না হলে আমাদের ভবিষ্যত যে কেমন হবে তা অন্য একদিন না হয় লিখবো।অবশ্য আমি না লিখলেও সবাই অনুমান করেত পারে বলেই আমি মনে করি।

কোন মন্তব্য নেই: