রাতে কারো ঘুম আসছিলনা। লাইটস অফের ঘন্টা বাজলেই বা কার কি। চিন্তা একটাই
কালতো প্যারেন্টস ডে।ক্যাডেট লাইফে প্যারেন্টস ডে মানেই ক্যাডেটদের ঈদের
দিন।হয়তো আমারও। কিন্তু কালকের প্যারেন্টস ডেটাকে কেন যেন ঈদের দিন ভাবতে
পারছিনা। রাত পেরিয়ে সকাল হলে যে প্যারেন্টস ডেটা আসবে সেটি যে আর কোন দিন
ফিরে আসবেনা। এক জীবনে আর কোন দিন প্যারেন্টস ডে আসবেনা আমাদের জীবনে। যদিও
সারা জীবন বাবা মায়ের সাথে থাকলে প্রতিদিনই প্যারেন্টস ডে হিসেবে ধরে
নেওয়া যাবে কিন্তু কলেজ লাইফের শেষ প্যারেন্টস ডে হওয়ায় এই অনুভূতিটা
অন্যরকম। ভাবতেই পারছিনা এই প্রিয় আঙিনা ছেড়ে চলে যেতে হবে।আর কোন দিন
আমাদের জীবনে এই আঙিনায় প্যারেন্টস ডে নামের আড়ালে ঈদের আনন্দ ফিরে আসবে।
সবাই কম বেশি নির্ঘুম কাটাচ্ছে।মনের মধ্যে প্যারেন্টস ডের আনন্দের চেয়ে
ফুরিয়ে যাওয়া বেদনাটাই বেশি।মনের অজান্তেই যেন চোখে পানি চলে আসছে।একদিন এই
চত্ত্বরে বাবা মা যখন রেখে গিয়েছিল সেদিনো আমরা কেঁদেছিলাম। সেদিনও
কেদেছিলাম কষ্টে। কিন্তু এখন যে কাদছি সেটাও কষ্টের কিন্তু এই কষ্টটা এই
আঙিনা ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট।
আমার পাশের বেডে তোফায়েল।তোফায়েল ঘুমায়নি।
সে ডায়রি নিয়ে বসেছে।কি কি সব লিখছে।তার মনে কোন বেদনার ছায়াও দেখতে
পাচ্ছিনা।
প্রতিবার প্যারেন্টস ডেতে ওকে আর সবার মতই আনন্দিত দেখায়। তার
মানে এবারও সবার মত তাকে বিষন্ন দেখানোর কথা ছিল কিন্তু হয়েছে তার উল্টোে।
সেই একমাত্র খুশিতে আটখানা হয়ে আছে। ব্যাপারটা বুঝতেই পারিনি। বার কয়েক
জিজ্ঞেস করলেও সে কিছু বলেনি। শুধু মুচকি মুচকি হেসেছে।
এর আগে যত
বার প্যারেন্টস ডে এসেছে ততোবারই দেখেছি তোফায়েলের বাবাই শুধু এসেছেন।কোন
দিন ওর আম্মুকে আসতে দেখিনি। ভাই বোনও কখনো আসেনি। আমি আর কোন কিছু না ভেবে
ঘুমাতে চেষ্টা করলাম।
লাস্ট প্যারেন্টস ডেতে আমাদের প্রায় সবারই
বাবা মা ভাই বোনেরা এসেছে। কারণ এবার না আসলে পরেতো আর কোন প্যারেন্টস ডে
পাবেনা।আমরা একই সাথে আনন্দিত এবং আর কোন প্যারেন্টস ডে পাবোনা ভেবে
বিষন্নও কিছুটা। সবাই সবার সাথে গল্প করছি।একজন আারেকজনকে তার মা বাবা ও
পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।
হঠাৎ চোখ গেল তোফায়েলের দিকে।সে
দেখি এক ভদ্রমহিলা আর একটা সমবয়সী কিংবা অপেক্ষাকৃত কম বয়সী মেয়ের সাথে
হেসে হেসে কথা বলছে। আমি আর মুকাব্বির এগিয়ে গিয়ে ওর পিঠ চাপড়ে দিলাম।সে
আমাদেরকে ভদ্রমহিলার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো এই আমার আম্মু আর আমার ছোট বোন
লামিয়া। আমি আর মুকাব্বির ওর আম্মুকে সালাম দিলাম। এর আগে কোন প্যারেন্টস
ডেতেই তারা আসেনি। আমি আন্টিকে বললাম আগে কেন আসেননি প্যারেন্টস ডেতে। শুধু
আংকেলই আসতেন। তিনি জানালেন তার কাজ থাকে তাছাড়া সময়ও খুব একটা হয়ে ওঠেনা।
এটা যেহেতু শেষ প্যারেন্টস ডে আর ওর বাবা যেহেতু আসতে পারতেছেনা তাই আমি
আর লামিয়া আসলাম।
আর কথা না বাড়িয়ে ওদেরকে রেখে আমি আর মুকাব্বির
নিজেদের বাবামাকে নিয়ে মেতে উঠলাম। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখাচ্ছি এমন সময় এক
ভদ্রলোক আমাকে নাম ধরে ডাকদিলেন। আমি ফিরে তাকিয়েই চিনতে পারলাম। তোফায়েলের
বাবা! আমি সালাম দিয়ে আংকেলকে বললাম আংকেল তাহলে আপনিও এসেছেন। আন্টিতো
বললো যে আপনি কাজের চাপে আসতে পারছেন না তাই তিনি একাই এসেছেন। তিনি আমার
মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। হঠাৎ খেয়াল করলাম তার পাশে আরেকজন ভদ্রমহিলা আর
ছোট্ট আট নয় বছরের একটা মেয়ে। তিনি কিছুটা সময় নিয়ে জানতে চাইলেন আন্টি
মানে?তোফায়েলের আম্মুতো আমার সাথেই আছে।
আমি তখন খেয়াল করে দেখলাম
সত্যি সত্যিই আংকেলের পাশে আন্টি আর তোফায়েলে বোন। আমি পিচ্চিটার মাথার
চুলে বিলি কেটে বললাম কেমন আছ লামিয়া?সে হেসে দিয়ে বললো ভাল আছি ভাইয়া। আমি
বুঝলাম এলাহী কান্ড ঘটতে চলেছে।কিন্তু যেন ঝামেলা না হয় তাই আংকেলকে আগেই
বললাম যে কোন সিনক্রিয়েট না করতে। কারণ সিনক্রিয়েট করলে কলেজ কর্তৃপক্ষ না
জানি কি করে বসে।
আমি মুকাব্বিরকে ডাক দিলাম।সে দৌড়ে আসলো।আমি পরিচয়
করিয়ে দেওয়ার আগেই মুকাব্বির তোফায়েলের বাবাকে চিনতে পারলো এবং সালাম
দিল।আমি ইশারা করতেই ও বুঝে গেল কি ঘটেছে। আমি আর মুকাব্বির যেন বীর দর্পে
আংকেল আর আন্টিকে নিয়ে তোফায়েলের দিকে রওনা হলাম। দুর থেকেই দেখলাম তোফায়েল
তার বোন মানে লামিয়াকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। লামিয়াও মাঝে মাঝে
তোফায়েলকে খাইয়ে দিচ্ছে। আহ কি প্রশান্তি। কি ভালবাসা ভাই বোনের
মধ্যে।ওদিকে লামিয়া কিন্তু আমার পাশে পাশে হাটছে!
আমি তোফায়েলের
সামনে গিয়ে দাড়ালাম। তার পর সেই আন্টিকে বললাম আন্টি আংকেলতো এসেছেন।তিনি
মনে করেছেন আপনি একা একা প্যারেন্টস ডেতে কিভাবে না জানি সময় কাটাবেন তাই
তিনিও ছুটে এসেছেন। সাথে সাথে তার মুখটা কালো হয়ে গেল।আমি আর মুকাব্বির
ছাড়া কেউ কিছু জানতে পারলোনা।মুকাব্বির অবশ্য তোফায়েলকে বাগে পেয়ে ছেড়ে
দেয়নি খালিহাতে। সে সাজানো লামিয়া মানে তোফায়েলের গার্লফ্রেন্ডকে বললো বাবা
এসেছেন পা ছুয়ে সালাম করো।আর সাজানো লামিয়ার মাকে বললেন আন্টি আপনি চুপ
করে বসে আছেন কেন। আংকেল এসেছেন আংকেলের সাথে ঘুরে ঘুরে দেখুন সব।
দিন শেষে বাবা মা ফিরে গেছেন।গত রাতে যে তোফায়েলের মুখটা হাজার ওয়াট
বাল্বের মত উজ্জ্বল ছিল সেই তোফায়েল গোমরা মুখে বসে আছে।আমাদের উপর তার রাগ
হয়নি মোটেও। এমন পরিস্থিতি ঘটবে তা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। বন্ধুদের বলে রাখা
ছিল প্যারেন্টস ডের সময় খোজ নিয়ে জানতে যে বাবা মা আসবে কিনা। যদি কোন
প্যারেন্টস ডেতে বাবা মা না আসেন তবে যেন গার্লফ্রেন্ডকে বোন সাজিয়ে লিপি
আপাকে মা সাজিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। লাষ্ট প্যারেন্টস ডের আগে তোফায়েলের
গ্রামের বন্ধু নাজির গিয়ে ওর বাবার কাছে জানতে চাইলো কাকা প্যারেন্টস ডেতো
এসে গেল তা কে কে যাবেন এবার। তোফায়েলের বাবা বললেন এবার কেউ যেতে পারছিনা
বাবা। নানা ঝামেলার মধ্যে আছি।বন্ধু উপস্থিত থাকতেই বাবা তোফায়েলকে ফোন করে
সেটা জানিয়েও দিল।তোফায়েলের সুযোগ হয়েছিল নাজিরের সাথে এক মিনিট কথা বলার।
যেহেতু অনেক আগে থেকেই ওসব শিখিয়ে দেওয়া আছে তাই তোফায়েল নাজিরকে
বলেছিল দান দান তিন দান শেষ দান আমাদের। এতেই সে যা বুঝার বুঝে গিয়েছিল।
ওদিকে প্যারেন্টস ডে নিয়ে তাই তোফায়েলের ছিল সেইরকম আনন্দস্বপ্ন।
গার্লফ্রেন্ড আসতেছে।কেউ তাকে চেনেনা। বোন বলে পরিচয় করিয়ে দিবে।মুখে তুলে
খাইয়ে দেবে আর কাধের উপর হাত রেখে পাশাপাশি হাটবে এর থেকে রাজ কপাল আর কি
হতে পারে।
অপর দিকে তোফায়েলের বাবা আগের রাতে চিন্তা করলেন ছেলেতো
কদিন বাদেই চলে আসবে কলেজ থেকে। এটাই জীবনের শেষ প্যারেন্টস ডে।তাছাড়া ওর
মা আর লামিয়াকেও কোন দিন কলেজে নেওয়া হয়ে ওঠেনি কেবল মাত্র ভর্তির দিন
ছাড়া। তাই তিনি মত পাল্টে লাস্ট প্যারেন্টস ডেতে উপস্থিত হবেন বলে
সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি ভেবেছিলেন ছেলেকে চমকে দেবেন।তিনি যতটা ভেবেছিলেন
তার থেকে শত গুন বেশি চমকেছে তোফায়েল।সেই সাথে তোফায়েলের বাবা মাও চমকেছে।
শেষ প্যারেন্টস ডের কথা তাই তোফায়েলের মনে থাকবে সারাজীবন। এমনকি আমাদের
চেয়েও বেশি।
১৫ মে ২০১৬
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন