------জাজাফী
জ্ঞান
ফেরার পর তন্ময় প্রথম যে মুখটি দেখেছিল সেটি ছিল অন্তরাদির মুখ।সাত দিন পর ওর
জ্ঞান ফিরেছে।শরীরে শক্তি নেই বললেই চলে।অনেক চেষ্টা করে সে তার ডান হাতটা
অন্তরাদির মুখের কাছে নিয়ে তাকে ছুয়ে দেখলো।শক্তির অভাবে হাতটা আপনা আপনি নেমে এলো
নিচেয়।সে অস্ফুট স্বরে জানতে চাইলো, তুমি কে?তুমি কি মাদার তেরেসা? অন্তরাদি ফিক
করে হেসে দিয়ে বললো,মাদার তেরেসা হেইডা আবার ক্যাডা?আমি অন্তরা। আমারে তুমি অন্তরা
দিদি কইয়া ডাকতি পারো।
তন্ময়
আর কথা বাড়াতে পারেনি। ক্লান্ত হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। সাত বছরের তন্ময়ের উপর দিয়ে
যে ধকল গিয়েছে তা তার ছোট্ট শরীর সহ্য করতে পারেনি।সৃষ্টিকর্তার কৃপায় সে বেঁচে
আছে কোন মত।দীর্ঘ ক্লান্তিকর ঘুমের পর সে জেগে উঠে শুধু মাত্র একটি কথাই জিজ্ঞেস
করেছে, আমার অন্তরাদি কোথায়?নার্স ওর কথাতেই বুঝতে পেরেছে সে অন্তরাকে খুঁজছে।কিন্তু
নার্সতো জানেনা ওর দিদি কোথায় আছে।তন্ময় ঘুমিয়ে যাওয়ার পরই অন্তরা বেরিয়ে
গেছে।অন্তরার বয়স তের।থাকে টিকাটুলি বস্তিতে।
সলিমুল্লাহ
মেডিকেল কলেজের চাইল্ড স্পেশালিস্ট ডা.জোবায়ের হাসান পত্রিকার পাতা উল্টাচ্ছেন।মনে
মনে বিরক্তও হচ্ছেন। পড়ার মত তেমন কোন সংবাদই তার চোখে পড়ছেনা।এ পাতা ওপাতা করতে
করতে হঠাৎ একটা বিজ্ঞাপন তার চোখে পড়লো।সাত আট বছর বয়সী একটা ছেলের ছবি নিচেয় লেখা
সন্ধান চাই।বিস্তারিত পড়ে জানতে পারলেন ছেলেটি স্কুল থেকে আর বাসায় ফিরে আসেনি।
ড্রাইভার ওকে স্কুলে আনতে গিয়ে জানতে পারে স্কুল থেকে ও আগেই বেরিয়ে গেছে।তার পর
কত খোঁজাখুজি করেছে কিন্তু কোথাও পায়নি ওকে।বিগত সাত দিন ধরেই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন
দেওয়া হচ্ছে। ডাক্তার জোবায়ের হাসানের কেন যেন মনে হচ্ছে এই ছবির ছেলেটিকে তিনি
দেখেছেন কোথাও কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছেন না।তিনি যখন এসব ভাবছেন তখন নার্স এসে
জানালো ২৭ নাম্বার ওয়ার্ডের বাচ্চা ছেলেটির ঘুম ভেঙেছে আর সে খুব কান্নাকাটি করছে।
পত্রিকা
রেখে দ্রুত উঠে গেলেন ডাক্তার জোবায়ের হাসান।বিছানার ওপর যে ছেলেটি শুয়ে আছে তাকে
দেখে তিনি চমকে উঠলেন।পত্রিকায় ওর ছবিইতো দিয়েছে।অথচ সাত দিন ধরে ও তারই
তত্ত্বাবধায়নে চিকিৎসা নিচ্ছে।ছেলেটি তার ক্লান্ত কন্ঠে বার বার একজনের নাম ধরেই
ডাকছে।আমার অন্তরাদি কোথায়? তাকে আমার কাছে নিয়ে আসো।ডাক্তারের মনে পড়ে গেল সাত
দিন আগে তের চৌদ্দ বছর বয়সী একটা মেয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় এই ছেলেটিকে নিয়ে এসেছিল।মেয়েটির
খালি পা, শরীরে ময়লা কাপড়,রুক্ষ এলোমেলো চুল।সেই ছোট্ট মেয়েটিই তার কোমরে গুজে
রাখা চারশো টাকা ডাক্তারের হাতে ধরিয়ে দিয়ে করুণ সুরে বলেছিল “আমার ভাইডারে বাঁচান
ডাক্তার সাব। আমি আরো ট্যাকা লইয়া আমু”।ডাক্তার শুধু একটি কথাই জানতে চেয়েছিলেন
তোমার নাম কি?ওপাশ থেকে জবাব এসেছিল অন্তরা।
ডাক্তার
মনে মনে ভেবেছিলেন সত্যিই অন্তর দিয়ে ভালবাসতে পারে যে তার নামইতো অন্তরা হওয়া
উচিত। এর পর সাত দিন কেটে গেছে।তন্ময়ের এক্সিডেন্টের ঘটনাও জানা হয়েছে।স্কুল থেকে
বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে একটু দুরেই চলে গিয়েছিল।হঠাৎ একটা গাড়ি দ্রুত বেগে এসে ওকে
প্রচন্ড জোরে ধাক্কা দেয়। ও ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে। আসেপাশে কোন লোক ছিলনা।বাস
দ্রুতবেগে পালিয়ে যায়। অন্তরা নামের ছোট্ট মেয়েটি তখন ওদিকেই কাগজ কুড়াচ্ছিল।সব
ফেলে দিয়ে সে ওকে সলিমু্ল্লাহ মেডিকেলে নিয়ে গিয়েছিল।
ডাক্তার
অবাক হয়ে ভেবে দেখলেন ময়লা কাপড়ের ছোট্ট মেয়েটি কিভাবে কিভাবে যেন সত্যি সত্যিই
অসুস্থ্য ছেলেটির চিকিৎসার টাকা জোগাড় করেছে।একবারও মনে হয়নি ছেলেটি তার কিছুই
হয়না।এই সাতটা দিন ছোট্ট মেয়েটিই তন্ময়ের সেবা করেছে।তন্ময় তখন অনিশ্চিত ভবিষ্যত
নিয়ে বেঁচে ছিল।রাতে ওর বিছানার পাশে মেঝেতে বসে কাটিয়ে দিয়েছে ছোট্ট
মেয়েটি।ডাক্তার তার জীবনে এমন ভালবাসা কোন দিন দেখেনি।
তন্ময়
তখনো সমানে কেঁদে চলেছে।অন্তরাদিকে ডাকো, আমার অন্তরাদি কোথায়?ডাক্তার কোথায় পাবে
অন্তরাকে?হঠাৎ মনে পড়লো পত্রিকার বিজ্ঞাপনের নিচেয় ঠিকানা আর মোবাইল ফোন নাম্বার
দেওয়া আছে।তিনি সাথে সাথে ফোন করলেন।ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করতেই ডাক্তার জানতে চাইলেন
আপনি কি তন্ময় নামে কাউকে চেনেন?আমি সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তার জোবায়ের
হাসান বলছি।তন্ময় আমাদের এখানে ভর্তি আছে।
যিনি
ফোন ধরেছিলেন তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন এবং ফোনটা রেখে দিলেন। ডাক্তার জোবায়ের
হাসান জানেন এটা ফিরে পাবার কান্না।এর মাত্র বিশ মিনিটের মধ্যেই একটা কালো পাজেরো
এসে থামলো সলিমুল্লাহ মেডিকেলের সামনে।গড়ি থেকে দ্রুত নেমে করিডোর ধরে ডাক্তারের
রুমে হাজির হলেন মিষ্টার কৌশিক এবং তার স্ত্রী।মিষ্টার কৌশিক দেশের ধনাঢ্য একজন
ব্যক্তি।ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ তার চোখে মুখে।হাসপাতালের বেডে থাকার পরও তিনি
যে তার সন্তানকে ফিরে পেয়েছেন এটাই তার বড় পাওয়া। যদিও তিনি জানেন না কোন অবস্থায়
তিনি তার একমাত্র ছেলেকে দেখতে চলেছেন। ডাক্তার তাদের দুজনকে শান্ত হয়ে বসতে
বললেন।গ্লাসে পানি ঢেলে দিয়ে তাদের আশ্বস্থ করলেন যে তন্ময় ভাল আছে।কিছুক্ষণ পর
তিনি দুজনকেই তন্ময়ের কাছে নিয়ে গেলেন।তন্ময় বেশ সুস্থ্য বোধ করছে। সে বিছানায় বসে
ডিম পোচ আর রুটি খাচ্ছে।শরীর দুবর্ল হলেও সে আগের থেকে অনেক সুস্থ্য।মা বাবাকে
দেখে সে তাদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
এক
ঘন্টা বাদে তন্ময়কে নিয়ে তার বাবা মা বেরিয়ে গেলেন বাসার উদ্দেশ্যে।যাওয়ার সময়
ধন্যবাদ দিলেন ডাক্তারদের।ছেলেকে ফিরে পেয়ে তারা এতোটাই হারিয়ে গিয়েছিলেন যে ছেলে
কিভাবে এখানে আসলো কি হলো না হলো তা নিয়ে কথা বলতেই ভুলে গিয়েছিলেন।বিল পরিশোধ
করতে গিয়ে মিস্টার কৌশিক চমকে উঠলেন।তন্ময়ের দিদিই নাকি সব বিল পরিশোধ করে
দিয়েছে।সামান্য বিল! সাড়ে তেরশো টাকা মাত্র।তার পরও চমকে উঠলেন তন্ময়ের বাবা মা। তন্ময়ইতো
তাদের একমাত্র সন্তান। তাহলে দিদি আসলো কোথা থেকে।ডাক্তার যতটা জানে তা
বললেন।তন্ময়ও তার অসুস্থ্য শরীর নিয়ে যতটা জানা ছিল বললো।সব শেষে বললো আমার দিদিকে
না নিয়ে আমি বাসায় যাব না।ছেলের কথা মত ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করলেন মেয়েটির আসার
অপেক্ষা নিয়ে। কিন্তু অন্তরা আর আসলো না।
সন্ধ্যার
কিছুক্ষণ আগে ডাক্তার জোবায়ের যখন বাসার উদ্দেশ্যে নিজের গাড়িতে উঠছেন তখন দেখা
গেল হাসপাতালের গেট দিয়ে অন্তরা আসছে। তিনি গাড়ি থেকে নেমে দাড়িয়ে গেলেন।অন্তরার
মুখে টানা হাসি।হাতে একটা পলিথিনের ব্যাগে কিছু আপেল আর একটা বেদানা।শরীরে সেই
ময়লাওয়ালা জামা এবং পা খালি।ডাক্তারকে দেখে সে বললো “আমার ভাইডার জন্যি নিয়া
আইলাম।আমার ভাইডা এইডা খালি তাড়াতাড়ি ভালা অইয়া যাবো”।
ডাক্তারের
চোখ দিয়ে পানি চলে আসলো।সে অন্তরাকে কাছে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলেন।ময়লা শরীরের
অন্তরাকে আর সাধারণ কোন মানুষ মনে হলো না। তিনি ওর কপালে যখন চুমু খেলেন তখন তার
চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়লো।অন্তরা সারা জীবনে এমন অবাক হয়নি কখনো।বস্তিতে থাকে।
বাবা মা আত্মীয় কেউ নেই।বস্তির এক পিসি তাকে দয়া করে থাকতে দিয়েছে।রোজ পথে পথে
কাগজ কুড়িয়ে যা পায় তা সেই পিসিকে দেয়।কিছু কিছু সে জমিয়েও রাখে।কোন দিন কেউ তাকে
বুকে জড়িয়ে নিয়েছে বলে মনে পড়েনা।
সে
ডাক্তারের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার পর খেয়াল করে ডাক্তার কাঁদছেন। অন্তরা
অবাক হয়।ডাক্তার চোখ মুছে ধরা গলায় বলেন অন্তরা তোমার ভাই সুস্থ্য হয়ে তার বাবা
মার সাথে বাসায় চলে গেছে।এরকম কঠিন একটা সংবাদ দিতে ডাক্তারের বুক কেঁপে
ওঠে।কিন্তু অন্তরা কিংবা তন্ময়ের অন্তরাদির কোন ভাবান্তর হয়না। সে খুশি মনে বলে “আমার
ভাইডা ভালা অইয়া গেছে! হেইডা আগে কইবেন না?।পরে ফলের প্যাকেটটা ডাক্তারের হাতে
দিয়ে বলে, “এইডা আপনে লইয়া জান। আমার ভাইডার জন্যি আনছিলাম হেইতো নেই তাইলে এইডা
খাবো কেডা?আমিতো এগুলান খাইনা। হজম অয়না”।তার পর অন্তরা বেরিয়ে যায়।ডাক্তার অনেকক্ষণ
তার চলে যাবার দিকে তাকিয়ে থাকে।
বাসায়
ফিরে ডাক্তার জোবায়ের হাসান দেখলেন তার এক মাত্র মেয়ে ঈশিতার গলায় বেশ সুন্দর একটা
চেন।সে সেটা বাবাকে দেখিয়ে বললো জানো বাবা এটা আম্মু আমাকে কিনে দিয়েছে।রান্না ঘর
থেকে স্ত্রীর কন্ঠ ভেসে আসলো।তিনি বললেন, একটা ছোট্ট মেয়ের কাছ থেকে এই চেনটা এক
হাজার টাকা দিয়ে কিনেছি।রুপার চেন, তবে মডেলটা সুন্দর। তাছাড়া মেয়েটা হয়তো
চুরিটুরি করছে।আমাকে বলেছে তার নাকি বাবা মা আত্মীয় স্বজন কেউ নেই। তার একমাত্র
ভাই তন্ময় না কি যেন নাম, খুব অসুস্থ্য তাই তার চিকিৎসার জন্য সে তার মায়ের
একমাত্র স্মৃতি এই চেনটা বিক্রি করতে চায়।আমি ওর কোন কথাই বিশ্বাস করিনি।তবে চেনটা
পছন্দ হওয়ায় একহাজার টাকা দিয়ে বিদায় করেছি। সোফাতে বসতে বসতে ডাক্তার জোবায়ের
হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।তার স্ত্রী কন্যা জানতেও পারলেন না ডাক্তার কেন কাঁদছেন।
বাসায় ফিরে গিয়ে তন্ময় ক্লান্ত শরীরে রং তুলি নিয়ে বসে
গেল।বাবা মা নিষেধ করার পরও সে ছবি আঁকতে শুরু করলো।যে ছবিটা আঁকলো সেটা একটা
ছোট্ট মেয়ের ছবি।খালি পা,শরীরে ছেড়া একটা জামা।অপটু হাতে আঁকা ছবিতেও তন্ময় তার
একমাত্র দিদিকে ভালই একেছে। সে অবাক হয়ে দেখছে তার অন্তরাদি তার দিকে তাকিয়ে হাসছে
আর বলছে ”মাদার তেরেসা?হেইডা আবার ক্যাডা?আমারে তুমি অন্তরা দিদি কইয়া ডাকতি পারো”।তন্ময়ের
চোখ ভিজে ওঠে।অন্তরাদি অন্তরাদি বলে হু হু করে কেঁদে ওঠে।আম্মু ছুটে এসে ছোট্ট
তন্ময়কে বুকে জড়িয়ে নেয়। কিন্তু অন্তরাদি ছাড়া যেন ওর কান্না কোন দিনই থামবেনা।
১৩
মে ২০১৬
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন