এস এস সি পরীক্ষা শেষ করে বাসায় পৌছানোর আগেই রেজাল্ট বেরিয়ে গেল। বিশ্বাস
হচ্ছেনা তাইনা? ঠিক আছে বলছি তাহলে সেই ঘটনাটা । অন্তরা আর তন্ময় দুই ভাই
বোন। তন্ময় বড় আর অন্তরা ছোট। ভিকারুননিসা নুন স্কুল থেকে অন্তরা এবার
এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। ওদের বাসা উত্তরাতে। ঢাকা শহরের যানজটের অবস্থা দিন
দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। তাই কোন রিস্ক না নিয়ে পরীক্ষা চলাকালিন
সময়টাতে অন্তরাকে নিয়ে তন্ময় ওর খালামনির বাসায় উঠেছে। খালামনির বাসা
সেগুনবাগিচায়। যেখান থেকে অন্তরার পরীক্ষার কেন্দ্র পায়ে হাটা দূরত্ব। নানা
ঝামেলার মধ্য দিয়ে আজ পরীক্ষা শেষ হয়েছে, তাই খালামনির কাছ থেকে বিদায়
নিয়ে তন্ময় ছোট বোনটাকে নিয়ে উত্তরায় নিজেদের বাসার দিকে রওনা হল। খালামনির
বাসা থেকে বেরিয়ে একটা ভাল মানের এসি বাসে উঠে বসেছে। অন্তরা বসেছে
জানালার ধারে।
বাসে উঠতে না উঠতেই বাস দাড়িয়ে গেল। যে ভয়ে অন্তরাকে
নিয়ে খালামনির বাসায় উঠেছিল সেই জ্যাম লেগেছে। আধা ঘন্টা হয়েছে গাড়িতে
উঠেছে কিন্তু গাড়ি দশ হাতও সরেনি। যাত্রীদের চোখে মূখে বিরক্তির ছাপ। এর
মাঝেই এক পত্রিকার হকার উঠলো পত্রিকা বিক্রি করতে। যাত্রীদের আর কিছু করার
ছিলনা তাই প্রায় সবাই পত্রিকা কিনলো আর দেখতে দেখতে ছোট্ট ছেলেটার হাতের সব
গুলো পত্রিকা বিক্রি হয়ে গেল। তন্ময় ছেলেটাকে ডাক দিলো, এই ছেলে শোন।
ছেলেটা তন্ময়ের সামনে এসে দাড়ালো। ওর নাম উৎসব। তন্ময় বললো তোর নামটাতো
সুন্দর আর আজকে তো দেখছি সত্যিই তোর উৎসবের দিন। তোর সব পত্রিকাতো বিক্রি
হয়ে গেলরে। নিশ্চই অনেক লাভ হয়েছে। এগার বছরের উৎসব তখন অনেকটা হতাশ হয়ে
বললো “আর কইয়েন না ভাইজান সব গুলান বেইচ্চা লাভ অইচে চারশো টিহা,সব হিসাব
করলে আমার লাভ কিন্তু মাত্র একশো টিহা”।
অন্তরা আশ্চর্য হয়ে জানতে
চাইলো কিভাবে? তখন সে অন্তরার দিকে ঝুকে চুপিচুপি বললো “ আফা কাউরে কইয়েন
না কিন্তু এই যে জ্যাম অইছে এইডা কিন্তু আমাগো চুক্তির জন্যি হইছে”। অন্তরা
আরো বেশি আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলো জ্যাম কিভাবে চুক্তির জন্য হয়? ছেলেটা
তখন বললো “মালিক সমিতিগো কওয়া আছে যদি জ্যাম ফালাতি পারেন তালি কলাম আমাগো
সব পত্রিকা বিক্কিরি অইবো,আর যে লাভ পামু তার থাইক্কা আপনেগো এট্টা অংশ
দিমু”। হেইর লাইগাইতো ওরা জ্যাম ফালায়। এই যে আইজা জ্যামে আমার সব বিক্কিরি
অইলো এই লাভের টাহা থাইক্কা সমিতিতে দুইশো ট্যাহা দিতি অবি। বাকি থাকবি
দুইশো টিহা। সেই দুইশো টিহা থাইক্কা একশো টিহা আমার মালিকের লাগি আর একশো
টিহা নিজের”।
তন্ময় আর অন্তরা দুজনেই ওর কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেল।
ছেলেটা ততক্ষণে নেমে গেছে। জ্যাম ছেড়ে গাড়িটা কিছুদূর এগিয়েছে আর অমনি
আবার জ্যাম লাগলো। অলরেডি তিন ঘন্টা পেরিয়ে গেছে তন্ময়রা গাড়িতে উঠেছে।
অথচ মাত্র এক স্টপেজ পার হতে পেরেছে। পত্রিকা পড়ে পড়ে সবাই মনে হয় ক্লান্ত।
এখন পেটে ক্ষুধাও লাগছে। কিছু খাওয়া দরকার। এর মাঝে এক বাদাম ওয়ালা উঠলো।
দেখতে দেখতে তার সব বাদাম শেষ হয়ে গেল। এই বাদাম ওয়ালা বয়সে একটু বড়। ওর
নাম অনীক। বাবা মা এতো সুন্দর নাম রেখেছে কিন্তু ভাগ্যের দোষে আজ বাদাম
বিক্রি করতেছে। আগের ছেলেটার কথাবার্তায় অন্তরা মজা পেয়েছে তাই ভাইয়াকে
বললো এই ছেলেটাকেও ডাকোতো ভাইয়া।
তন্ময় ওকেও ডেকে একই ভাবে লাভের
কথা বললো। অনীক নামের ছেলেটাও জানালো তাদের চুক্তি আছে যে, যত বেশি জ্যাম
হবে তাদের বিক্রি ততো বেশি হবে এবং লাভের অংশ পাবে মালিক সমিতি। এভাবে একে
একে আরো অনেক কিসিমের লোক বাসে উঠলো আর দুই ভাই বোন সবার সাথেই কথা বললো।
অন্যরা যখন তীব্র যানজটে বিরক্তির চরম সীমায় পৌছে নিজের চুল ছিড়ছে তন্ময় আর
অন্তরা তখন নানা কিসিমের মানুষের সাথে কথা বলে সময়টা আনন্দের সাথেই পার
করছে। গাড়ি যখন মালিবাগ মোড়ে এসে থামলো তখন রাত দশটা। ওরা গাড়িতে উঠেছিল
দুপুর দুইটায়। ওরা বুঝে ফেলেছে বাসায় পৌছাতে কত সময় লাগবে তা কারো ধারণাও
নেই। আব্বু আম্মুকে ফোনে জানিয়েছে ওরা বাসে উঠে বসেছে। আব্বু তন্ময়কে বলেছে
তোমার কাছে টাকা কত আছে? তন্ময় বললো ওর কাছে দুই হাজার টাকা আছে। বাবা
বললেন সকালে বিকাশ করে টাকা পাঠাবো।
এভাবে সারা রাত গেল। সকাল
এগারটার সময় ওরা মালিবাগ রেলক্রসিং পার হতে পারলো। কিন্তু তারপরই আবার
জ্যাম। সকালের নাস্তাটা ওরা ওখানেই শেষ করলো। কিছুক্ষণ পর এক জুতা কালি
ওয়ালা উঠলো। এর বয়সও এগার কি বার হবে। গাড়িতে বসে থাকলেতো আর জুতা ময়লা
হয়না তাই ওর ব্যাবসা খুব একটা জমেনি। তার পরও আগ্রহের খাতিরে তার সাথেও কথা
হলো তন্ময় আর অন্তরা। সেও জানালো চুক্তির কথা। ওর নাম মারু। আসলে হয়তো
বাবা মা শিক্ষিত হলে ওর নাম হতো মারুফ। তবে সে খুব গল্প প্রিয়। অন্তরা যখন
তাকে কাছে ডাকলো তখন এক গাল হেসে দিয়ে বললো “আফা আমিতো আপনের জুতা কালি
করতি পারুম না, আমি খালি ভাইজানগো জুতা কালি করি”।
ওর কথা শুনে
অন্তরা হেসে দিয়ে বললো না না আমার জুতা কালি করতে হবেনা। তুমিতো দেখি খুব
কথা বলতে পছন্দ করো। অন্তরার কথা শুনে ছেলেটা এক গাল হাসি দিয়ে বললো “তাইলে
শুনেন আফা এই যে জামে আটকা পইড়া আছেন কয়দিন হইলো? তন্ময় বললো তাতো প্রায়
দুইদিন হতে চললো। ছেলেটা তখন বললো এইডাতো কুন জামই না। জাম ছিল আগে। আমার
জন্মই অইছে জামের মধ্যি। বাজানের মুখ থাইক্কা হুনছি বাজান টঙ্গী থাইক্কা
যাইতেছিল সদর ঘাট। তহন রাস্তায় নাকি জাম ছিল। সেই জামে বাজান আটকা পড়ে ছিল
টানা তের মাস। সেই জামের মধ্যিই বাজানের সাথে আমার মায়ের পরিচয় অইছিল আর
বিয়াও অইছিলো। এর পর নাকি বাজান জামে আটকা পইড়া পাশের হুডেলে তাগো বাসর
করছিল। এমনকি সেই জাম কাডাইয়া বাজান সদর ঘাট যাওয়ার আগেই দশ মাস পার
অইগেছিল আর আমার জন্ম অইছিল”।
ওর কথা শুনে অন্তরা হো হো করে হেসে
উঠলো। তন্ময়ও খুব হাসলো এমনকি তীব্র যানজটে মেজাজ হারিয়ে ফেলা অন্যান্য সব
যাত্রীয় ওর কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলো। অলরেডি তন্ময়রা আট দিন জ্যামে
আটকে আছে। এর মধ্যেই ওদের পকেটের প্রায় সব টাকা শেষ। বাবা বিকাশ করে টাকা
পাঠিয়েছেন সেটাও তুলে আনা হয়েছে। এই যাত্রা পথের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার কথা
অন্তরা ওর ট্যাবে লিখে রেখেছে। আগামী বই মেলায় বই বের করবে। কিন্তু বইটার
কি নাম দেওয়া যায় তা ভেবে পাচ্ছেনা।
অতঃপর এক সকালে ওরা উত্তরা
নিজেদের বাসায় পৌছালো। কলিংবেল টিপতেই আম্মু দরজা খুলে দিল। আম্মুর মুখে
অনাবিল হাসি আর হাতে মিষ্টির প্যাকেট। অন্তরা আর তন্ময় দুই ভাই বোন অবাক
হয়ে জিজ্ঞেস করলো আম্মু কিসের মিষ্টি! আম্মু বললো অন্তরার এসএসসির রেজাল্ট
বের হয়েছে আজকে। ও গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে তার মিষ্টি। দুই ভাই বোন একে
অন্যের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবলো পরীক্ষা শেষ করে বাড়ি আসতে আসতেই
রেজাল্ট বের হয়ে গেল! বাংলাদেশতো সত্যিই ডিজিটাল হয়ে গেছে। যদিও যানজটের
কারণে ওরা একমাস পর বাসায় ফিরেছে! তবুও ওরা খুশি যে অন্তরার কলেজ ভর্তির
ডেট শেষ হওয়ার আগেই বাসায় ফিরতে পেরেছে।
...................................................
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন