ঘাস ফড়িং এর জীবন‬


===================================
----------‪#‎জাজাফী‬
===================================
আয়নার দিকে তাকাতে ভয় পাই। আমার মতই আয়না দেখতে ভয় পায় এদেশের ২৬ লাখ ৩১ হাজার যুবক। অবশ্য যুবক না বলে মধ্য বয়সীও বলা যেতে পারে। কারণ ৩০ পেরিয়ে গেলেই নাকি কেউ আর যুবক থাকেনা।আয়নার দিকে তাকালেই যে প্রতিচ্ছবিটি ভেসে ওঠে সেটা এক বেকার যুবকের প্রতিচ্ছবি। অবশ্য আয়নার দিকে তাকানোর প্রয়োজনও পড়েনা তাদের।কারণ চালচুলোহীন জীবনে আয়নায় মলিন মুখ দেখার মত বিলাসীতা ওই সব যুবক বা মধ্যবয়সীদের ভাগ্যেই লেখা নেই। আতিউতি করেও হয়তো তাই ঘরে একটা আয়না পাওয়া যাবেনা। 

ভাঙ্গা আয়নায় মুখ দেখলে নাকি অমঙ্গল হয়। কিন্তু ওই সব মানুষেরতো কোন আয়নাই নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যন ব্যুরো (বিবিএস) সম্প্রতি বাংলাদেশ শ্রমশক্তি জরিপের কাজ শেষ করেছে।সেই জরিপে দেখা গেছে দেশে বর্তমানে বেকার সংখ্যা ২৬ লাখ ৩১ হাজার। যারা সপ্তাহে এক ঘন্টাও কাজ করার সুযোগ পায় না। এদের মধ্যে মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পন্ন বেকারের সংখ্যা যথাক্রমে ৭ লাখ ৭৬ হাজার এবং ২ লাখ ৯২ হাজার। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করাদের মধ্যে ৭ লাখ ১৬ হাজার বেকার। আর স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ৯৪ হাজার মানুষ। 

ন্যুনতম জ্ঞান সম্পন্ন যে কেউ জানে এই জরিপ মোটেও ঠিক সেরকম না। অন্তত যারা চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছেন তারা নিশ্চই জানেন। একটা পদের বিপরীতে কয়েক লাখ আবেদন জমা পড়ছে যারা সবাই স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। তবে সরকার পক্ষের এ নিয়ে চিন্তার কোন কারণ নেই। কারণ জরিপে যদিও বলা হয়েছে মোট ২৬ লাখ ৩১ হাজার বেকার আছে কিন্তু আদতে বাংলাদেশে একজনও বেকার নেই।

এটা কোন দিবা স্বপ্ন নয় বরং এটাই সত্যি।বিশ্ব আজ অবাক চোখে তাকিয়ে দেখুক বাংলাদেশ শিশু মৃত্যুর হার কমিয়েছে, জিডিপিতে প্রবৃদ্ধির হার সন্তোষজনক অবস্থানে নিয়ে গেছে,যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে,পদ্মা সেতু করতে শুরু করেছে,বাল্য বিবাহ কমিয়েছে,জনসংখ্যা আনুপাতিক হারে কমিয়েছে এবং সর্বশেষ দেশ বেকার মুক্ত হয়েছে। এই যে বাংলাদেশে এতো এতো বেকার আছে বলে যেটা বলা হয়েছে তা নিয়ে মাথা ঘামাতে নিষেধ করেছে আর্ন্তজাতিক শ্রম সংগঠন আইএলও এর বেকারত্বের সংজ্ঞা। 

আইএলও বেকারদের সংজ্ঞা দিয়েছেন বেশ ভাল ভাবে এবং সেই সংজ্ঞা পড়ে দেশের সরকার এবং রাষ্ট্রযন্ত্র নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন এবং বাকিদের চোখের জল, বুকের হাতাশাকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারেন অনায়াসেই। আইএলওর সংজ্ঞা অনুযায়ি সপ্তাহে কেউ যদি অন্তত এক ঘন্টা গৃহস্থালির কাজও করেন তবে তাকে আর বেকারের তালিকায় রাখা যায়না।
সপ্তাহে এক ঘন্টা মানে দিনে আট মিনিট করে পরিশ্রম করার কথা বলা হয়েছে। এই আট মিনিট গৃহস্থালির কাজ করেনা এমন লোক এ দেশে একজনও নেই। সুতরাং আমাদের দেশে কোনই বেকার নেই। যেহেতু আমাদের দেশে কোন বেকার নেই সেহেতু কোম্পানী গুলো এখন থেকে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে শ্রম শক্তি আমদানী করতে পারে।দেশের সুনাম আরো বাড়বে। বর্হিবিশ্ব জানবে বাংলাদেশ এতোটাই উন্নত হয়ে গেছে যে বিদেশ থেকে শ্রমিক কর্মচারি আমদানি করছে।

জন সংখ্যা নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য আমরা কতরকম পদক্ষেপ নিয়েছি কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি। অথচ মুখের একটি কথাই রাতারাতি জনসংখ্যাকে স্থির করে দিয়েছে। এখন বেকারত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে বেঁচে থাকা ওই ২৬ লাখ ৩১ হাজার যুবক নাম ধারী মধ্যবয়সীদের দুই কুলই হারিয়েছে। সকালের সুর্য ওঠার আগেই তাদের বিয়ে ভেঙ্গে গেছে,বান্ধবী ছেড়ে চলে গেছে। 

সংজ্ঞা অনুযায়ি ৩০ পেরিয়ে গেলে কেউ আর যুবক থাকেনা। যেহেতু যুবক থাকেনা তাই কোন বাবা মাই চায়না তাদের মেয়েকে কোন মাঝ বয়সীদের সাথে বিয়ে দিতে। অন্য দিকে যদি যুবক কারো সাথে বিয়ে দিতে হয় তবে সে অবধারিত ভাবেই বেকার। কোন বাবা মা এটাও চায়না যে তাদের মেয়ের কোন বেকারের সাথে বিয়ে হোক। 

বিচুর্ণ আয়নায় মুখ দেখলে অমঙ্গল হয় এই ভাবনাটুকু ভাবার আগে আপনা আপনিই স্বপ্ন ভংগ হয়। আর যেহেতু বিয়ে হচ্ছেনা, যেহেতু মধ্য বয়সী হয়ে গেছে তাই সংসার সন্তান কোনটাই আর হবেনা। একই সাথে জনসংখ্যা নিয়মন্ত্রন হবে, বেঁচে যাবে বরাদ্দ কৃত জন্মনিয়ন্ত্রনের সামগ্রি।

একজন বেকার অতঃপর মধ্য বয়সীর বিয়ের মত বিলাসীতাও সাঝেনা। এ ছাড়াও শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই এমন বেকারও আছে ৪ লাখ ১৩ হাজারের অধিক। কিন্তু এটা নিয়ে ভাবার সময় কোথায়? আইএলও যেখানে বলে দিয়েছে দিনে আট মিনিট কাজ করলেই তাকে আর বেকার বলা চলেনা সেখানে আমরাতো প্রতিনিয়তই ঘন্টা ধরে বেঁচে থাকার জন্য লড়ছি।
কোন এক দায়িত্বশীল ব্যক্তি একদিন বলেছিলেন, এ দেশে কোন বেকার নেই। কারণ চাকরি খোঁজাও একটা কাজ। সেই দিক বিবেচনা করলে তার কথাটা অকপটে স্বীকার করতেই হয়। “কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে? কভু আসিবিষে দংশেনি যারে” বেকারত্বের যন্ত্রনা যে কী ভয়াবহ তা কেবল বেকারেরাই জানে। 

এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দরুন অধিকাংশই পাশ করে বের হতে হতে বয়স পেরিয়ে যায়। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো হবেনা। যে বাবার কাঁধে বসে বেকার হয়ে খাচ্ছি, সে বাবার অবসরে যাওয়ার বয়স বাড়ানো হচ্ছে কিন্তু যে ছেলেটি বেকার হয়ে বাবার কাঁধে বসে খাচ্ছে তার চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ছেনা। ফলে ভবিষ্যত আরো অনিশ্চিত হচ্ছে। 

ছেলেটির কর্ম সংস্থান হলে শেষ বয়সে বাবা মা তার উপর নির্ভর করতে পারতো সেখানে হচ্ছে উল্টো। প্রবীন বাবার উপর বোঝার মত চেপে বসছি আমরা। যে বয়সে কাজ করে খাবার কথা আমরা সেই বয়সে বাবার কাঁধে আলাদীনের দৈত্যের মত চেপে বসেছি। আর যে বয়সে বাবার একটু খানি আরাম করার কথা সেই বয়সে বাবাকে চাকরি করতে হচ্ছে।
চাকরি দাতা কোম্পানী গুলো লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে এমন সব অজুহাত দাড় করাচ্ছে যে অধিকাংশই খেই হারিয়ে ফেলছি।একটা চাকরির বিজ্ঞাপনে যত গুলো শর্ত থাকে তার একটা বাদে সব গুলোতে যোগ্য হওয়ার পরও সিংহভাগ মানুষ সেই চাকরিতে আবেদনই করতে পারছেনা। সেই একটি শর্ত হলো সাবজেক্টের খড়গ। 

যে যে বিষয়েই পড়ুকনা কেন তাকে অন্তত প্রতিযোগিতার বিশ্বে একটু খানি প্রতিযোগিতার সুযোগ দেওয়া উচিত।সেই প্রতিযোগিতায় যদি সে টিকে যায় তবে তাকে যোগ্য বলে মেনে নিতে সমস্যা কোথায় এ সমাজ ব্যবস্থার। প্রতিনিয়ত আমরাই নানা ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি করছি আবার আমরাই বলছি আমরা অসাম্প্রদায়িক, আমরা সমান অধিকারে বিশ্বাসী। এভাবে চলতে থাকলে নিশ্চিত একদিন এ শহর, এ আকাশ বেকারদের দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয়ে উঠবে। সে ভার কি সইতে পারবে এ আকাশ এ জাতি।
.........................................................................................................................
১২ মে ২০১৬

কোন মন্তব্য নেই: