#জাজাফী
মিস্টার অ্যালেক্স ২৬ বছর ধরে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে
আসা মানুষগুলোকে জায়গাটা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন।দীর্ঘ জীবন নানা পেশার নানা জাতির
মানুষের সাথে মিশে তার অভিজ্ঞতার ঝুলিটিও পরিপুর্ন।পর্যটকেরা তার মত গাইড পেলে
তাদের ভ্রমনে যোগ হয় অনেক বৈচিত্র।তিনি খুটিয়ে খুটিয়ে স্থানগুলো শৈল্পিক বর্ণনা
দিয়ে থাকেন।ফাহিম যখন প্রথম বার্কেনাভে গেল তখন ওর গাইড ছিলেন মিস্টার
অ্যালেক্স।ঘুরতে ঘুরতে তিনি নানা তথ্য জানাচ্ছিলেন। তিনি তার আঙুল উচিয়ে দুরে
বাউন্ডারি সীমানার বাইরে দাড়িয়ে থাকা নগ্নপ্রায় এক পাগলের দিকে ইঙ্গিত করলেন।বিগত
২৬ বছর ধরে তিনি ওই পাগলকে দেখছেন।মিস্টার অ্যালেক্সের আর সব বর্ননা শুনতে সবার
ভাল লাগলেও পাগলের কথা শোনার পক্ষে কেউ ছিলনা।তাই তিনি পাগল সম্পর্কে বলতে গিয়েও
কিছুই বলতে পারলেন না। তিনি ২৬ বছরের ট্যুর গাইড
জীবনে একজনকেও পান নি যে ওই পাগলের কথা শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
তিনি এবারও কোন কথা না বাড়িয়ে বাকি স্থাপনা গুলো দেখাতে
শুরু করলেন।পর্যটকরা যখন ঘোরা শেষ করলো তখন তার কিছুটা বিশ্রাম। পরবর্তী দল না আসা
পযর্ন্ত তার আর কোন কাজ নেই।বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা। তিনি চেয়ার টেনে বসলেন, সামনের
টেবিলে ধোয়া ওঠা কফির মগ।তিনি যখন আপন মনে কফিতে চুমুক দিচ্ছেন তখন তার পাশে এসে
দাড়াল তের বছরের ফাহিম। ফাহিম ওর বাবা মা আর ভাইয়ার সাথে ঘুরতে এসেছে।বাবা মা ফিরে
যেতে চাইলে ফাহিম জোর করে কিছুটা সময় নিয়েছে তাদের কাছ থেকে। তার পর সোজা চলে
এসেছে মিষ্টার অ্যালেক্সের কাছে।
হঠাৎ করে ফাহিমকে দেখে মিষ্টার অ্যালেক্স চমকে উঠলো।অনেক
মানুষের সাথে ওঠা বসা করলেও তার স্মৃতি শক্তি প্রখর। এই ছোট্ট ছেলেটিকে যে তিনি
কিছুক্ষণ আগে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো এরিয়াটা দেখিয়েছেন তা আবছা হলেও তার মনে আছে।
তিনি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেন। তবে কি ছেলেটি তার পরিবারকে হারিয়ে ফেলেছে? এখনতো
তাহলে এই ছেলেটিকে নিয়ে ঝামেলা হবে বেশ। পরবর্তী পযর্টক দলকে ঘুরিয়ে দেখানোর
পরিবর্তে এই ছেলেকে তার পরিবারের কাছে পৌছে দিতেই সময় পার হয়ে যাবে।
মিস্টার অ্যালেক্স পরিস্থিতি সামাল দিয়ে মুখে একটু হাসি এনে
জানতে চাইলেন ফাহিম কি তার পরিবারকে হারিয়ে ফেলেছে? ফাহিম উত্তর দিল যে সে তার
পরিবারকে হারিয়ে ফেলেনি। তারা বরং তার জন্য বাইরেই অপেক্ষা করছে।মিস্টার অ্যালেক্স
কৌতুহলী হয়ে উঠলেন?যিনি মানুষকে ইতিহাসের বেলাভূমি দেখাচ্ছেন বিগত ছাব্বিশ বছর ধরে
তার মধ্যে কৌতুহল থাকাই স্বাভাবিক। অজানাকে জানার আগ্রহ তাকে পেয়ে বসেছিল বলেই
হয়তো সে ট্যুর গাইড হয়েছিল।
মিস্টার অ্যালেক্স
এবার ওকে বসতে বললেন।ওকে কফি অফার করলেন।টেবিলে ফ্লাক্স ভর্তি কফি, পাশে এক্সট্রা
কাপও ছিল।ছোট্ট ফাহিম কফির আমন্ত্রন গ্রহণ করলো।কাপে কফি ঢালতে ঢালতে মিস্টার
অ্যালেক্স ফাহিমের আগমনের কারণ জানতে চাইলে খুব সাবলিল ভাবে ফাহিম বলতে শুরু করলো।
কথা বলাতে দুজনের কারো কোন সমস্যা হলনা কারণ মিষ্টার অ্যালেক্স ইংরেজী ভাষাভাষি
পাশাপাশি ফাহিমও ব্রিটিশ কারিকুলামে পড়ার কারণে ইংরেজীতে তুখোড়।
তের বছরের একটা ছেলের আগ্রহের বিষয় দেখে মিস্টার অ্যালেক্স
চমকে উঠলেন। ‘সিন্ডলার্স লিস্ট’র বধ্যভূমি সম্পর্কে সে জানতে চায়নি। এমনকি জানতে চায়নি তাদের সেই বিখ্যাত
দালান,রাজবাড়ি বা নগরকেন্দ্রের গল্প। যেগুলো সে সময় গুড়িয়ে দিয়েছিল হিটলারের
বাহিনী। আবার কেমন করে,নতুন করে বানানো হলো তার ইতিহাসও জানতে চায়নি।ছোট্ট ছেলেটি
জানতে চায় মিষ্টার অ্যালেক্সের দেখানো দূরে দাড়িয়ে থাকা নগ্নপ্রায় পাগল মানুষটির
কথা!
ছাব্বিশ বছরের ট্যুর গাইড
জীবনে কত কিছু দেখেছেন মিস্টার অ্যালেক্স। কত আজব মানুষের সাথে তার সাক্ষাৎ
হয়েছে। কত জন কত ধরনের প্রশ্ন করেছে কিন্তু ছোট্ট এই ছেলেটির সাথে অন্য সবাই যোজন
যোজন ব্যবধানে। এখন তার কাছে মনে হচ্ছে পরবর্তী কয়েক বছরও যদি সে নতুন পর্যটকদের
না ঘুরিয়ে ছেলেটির সামনে বসে থাকতে হয় তো থাকবে। ছেলেটি যে নগ্নপ্রায় মানুষটির কথা
জানতে চেয়েছে তাকে নিয়ে সমান আগ্রহ তার নিজেরও।সেই শুরুতেই লোকটিকে দেখেছেন। তখন
লোকটি ছিল যুবক বয়সী।টুকটাক কিছু কথাও জেনেছেন কিন্তু এতো বছরেও কোন দিন লোকটার
সাথে কথা বলা হয়নি।একজন নামকরা ট্যুর গাইড কেন একটা পাগলের সাথে কথা বলবে।পাগল
লোকটার নাম বার্কেনাভ!
নামটা শুনেই ফাহিম নড়ে চড়ে বসে। কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে
জানতে চায় তবেকি ওই লোকটার নামেই এই স্থানটাকে বার্কেনাভ বলা হয়? মিস্টার
অ্যালেক্স হাসেন।প্রথম দিকে তিনিও তাই মনে করেছিলেন। কিন্তু আসলে তা নয়।কাকতালীয়
ভাবে এই জায়গাটার নামের সাথে লোকটির নাম মিলে গেছে। তবে অধিকাংশই এখন আর ওসব মনে
রাখেনা। নতুন আসা পর্যটকেরা যদি কেউ জানতে পারে যে পাগলটার নাম বার্কেনাভ তবে ধরেই
নেয় তার নামেই স্থানটার নামকরণ করা হয়েছে। সে তো আহামরি কেউ ছিলনা যে তার নামে
একটা যায়গার নামকরণ করা হবে।
ফাহিমের হঠাৎ মনে পড়ে একটা ওয়াগন দেখিয়ে মিস্টার অ্যালেক্স
বলেছিলেন এই সেই বিখ্যাত বার্কেনাভের ওয়াগন। মিষ্টার অ্যালেক্সকে সে প্রশ্ন করে
এটা নিয়ে। মিষ্টার অ্যালেক্স চমকে ওঠে।ছোট্ট এই ছেলেটি এতো কিছু খুটিয়ে খুটিয়ে
লক্ষ্য করেছে?এতো কিছু মনে রেখেছে।তার ভাল লাগা আরো বেড়ে যায়।তিনি বলতে শুরু করেন
বার্কেনাভের ওয়াগন সম্পর্কে।লোক মুখে শুনেছে বার্কেনাভ নামক ওই পাগলটা সবাইকে বলে
বেড়ায় ওটা তার ওয়াগন।এভাবেই আস্তে আস্তে ওই ওয়াগনের নাম হয়ে ওঠে বার্কেনাভের
ওয়াগন।ওই ওয়াগনে করে হাজার হাজার নীরিহ নারী পুরুষ ও শিশুকে ধরে ধরে গ্যাস
চেম্বারে ঢুকিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। ফাহিমের আগ্রহ দেখে মিষ্টার অ্যালেক্সের নিজের
মনের মধ্যে জমে থাকা সুপ্ত আগ্রহটাও জেগে ওঠে। তিনি চট করে ফাহিমকে বলেন তবে কি
তুমিও চাও ওই পাগল বার্কেনাভের সাথে দেখা করে কথা বলতে।
ছোট্ট ফাহিম আশ্চর্য হয়ে ভাবে দুর বিদেশের এই মধ্য বয়সী
মানুষটি কত সহজেই না তার মনের ভাষা বুঝে ফেলেছে।সে তো সত্যিই ওই লোকটার সাথে দেখা
করতে চায়। কিন্তু ফাহিম জানেনা ঠিক তারই মত মিষ্টার অ্যালেক্সও দীর্ঘদিন ওই লোকটার
সাথে কথা বলার এবং ওই লোকটাকে নিয়ে ভাবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ফাহিমের মত কেউ
তাকে আগ্রহ দেখায়নি বলে নিজে কিছু করতে পারেনি।
ফাহিম আর মিষ্টার অ্যালেক্স বেরিয়ে আসলো।হ্যা দুর থেকেই
দেখা যায় পাগল প্রায় লোকটি কংক্রিটের ওপর স্তুপ হয়ে জমে থাকা বরফের আস্তরনে ঢাকা
জায়গাটিতে কি যেন করছে।বাইরে ফাহিমের ভাইয়া আর বাবা মা ওর জন্য অপেক্ষা করছিল।ও
বেরিয়ে আসতেই মা বললো এতো দেরি হলো কেন? চলো হোটেলে ফিরে যাই।ফাহিম জানালো ওর আরো
কিছু সময় চাই। মিস্টার অ্যালেক্সও জানালো হ্যা আমাদের আরো কিছু সময় চাই।
ভাইয়া বাবা মা তিনজনই অবাক হয়ে দেখলো অজানা অচেনা এই দেশে
ইংরেজ এক ট্যুর গাইডের সাথে ফাহিমের কী মধুর বন্ধুত্বইনা হয়ে গেছে।তারা জানতে
চাইলো কি জন্য সময় লাগবে তখন ফাহিম হেসে দিয়ে বললো ঐ যে দূরে দাড়িয়ে আছে যে পাগলটা,
আমরা দুজন তার সাথে কথা বলবো। এটা শুনে ভাইয়া হেসে দিল। বললো মানুষ দূর বিদেশে আসে
তার সৌন্দর্য তার ইতিহাস জানার জন্য আর আমাদের ফাহিম এসেছে পাগলের সাথে দেখা করতে,
কথা বলতে।
আম্মু বললেন বসুনিয়া পট্টিতে যে নুরা পাগলা আছে তার সাথেতো
কোন দিন কথা বলিস নি আর এখানে এসে এক পাগলে সাথে কথা বলবি। ফাহিম হেসে দিল, সেই
সাথে মিষ্টার অ্যালেক্সও। বাবা মার সাথে কি কথা হয়েছে, মিষ্টার অ্যালেক্স সেটা
বুঝতে না পারলেও অনুমান করে নিয়েছেন যে তারা পাগলে সাথে কথা বলবে বিষয়টা ফাহিমের
বাবা মা ভাইয়া হাসি ঠাট্টার পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
ফাহিম আর মিষ্টার অ্যালেক্সকে আর কষ্ট করে বলতে হলো না যে
তোমরা এখানে থাকো আমরা ঘুরে আসি।এমনিতেই তারা কেউ ওদের সাথে পাগলের কাছে যেতে
আগ্রহ দেখাল না। এতে করে দুজনেরই সুবিধা হলো। নিজেদের মত করে কথা বলা যাবে।
সবাই যাকে পাগল বার্কেনাভ বলে চেনে সে তখন আপন মনে বিড়বিড়
করছে।যেতে যেতে ফাহিম মিস্টার অ্যালেক্সকে প্রশ্ন করেছে বার্কেনাভ কোন ভাষায় কথা
বলে?কিংবা সে কি আদৌ কথা বলতে পারে?মিষ্টার অ্যালেক্সের এ বিষয়ে কোন ধারণা নেই।
তিনি অবাক হয়ে ভাবছেন বিগত ছাব্বিশ বছর দেখার পরও তার সাথে একবারও কথা বলা হয়ে
ওঠেনি!অবশ্য পাগলের সাথে কথা বলাই লাগবে এমনতো কোন নিয়ম করা নেই।তিনি ফাহিমকে
জানালেন নাম শুনে মনে হয় জার্মানি বা পোল্যান্ডের লোক।তাহলে ভাষাও নিশ্চই তাই হবে।
আবার এমনও হতে পারে সে অন্য কোন দেশের।কিংবা এমনও হতে পারে এখন আর সে ঠিকমত ভাষাই
ব্যবহার করতে ভুলে গেছে।
ওরা যখন বার্কেনাভের সামনে গিয়ে দাড়াল সে তখন বরফের ওপর
আকিবুকি করছে।ফাহিম আশ্চর্য হয়ে দেখলো বরফের এই দেশে সে যেখানে ওভারকোটের নিচেয়
আরো কয়েকপ্রস্থ কাপড় পরার পরও শীতে জমে যাচ্ছে সেখানে বার্কেনাভের পরনের ছেড়া
প্যান্ট টুকু ছাড়া সারা শরীরে আর কোন কাপড় নেই।তার হাত বা শরীর শীতে কাপছেনা।সে
যেন মানুষের দেহের আড়ালে পেঙ্গুইন বা মেরু ভল্লুক হয়ে গেছে।
ওদেরকে দেখে মাথা তুলে তাকাল বার্কেনাভ।
ফাহিম আর মিষ্টার অ্যালেক্স ওর সামনে বসলো।যে মানুষটিকে
সবাই অবহেলা করে আজ তারই সামনে বসে আছে দুজন স্বাভাবিক মানুষ। মিষ্টার অ্যালেক্স
কিছু বলার আগেই ফাহিম তার নাম ধরে ডাকলো।বার্কেনাভ ওর দিকে তাকাল।তার মানে এই নয়
যে সে ইংরেজী ভাষা বুঝেছে বা বুঝবে। নামতো যে যে ভাষারই হোক উচ্চারণ প্রায়
কাছাকাছিই হয়। ও আরো কিছু বললো কিন্তু বার্কেনাভ বুঝলো কিনা তা সে জানলো না।এবার
মিষ্টার অ্যালেক্স জার্মান ভাষায় কথা বললো। হ্যা লোকটা বেশ সচকিত হয়ে উঠলো। পাগল
হলেও তার ব্রেনের কিছু অংশ এখনো ভাল আছে বলেই মনে হলো।ওদের সাথে কথা বলতে বলতে
বার্কেনাভকে দেখা গেল উত্তেজনা বোধ করছে।
ফাহিম আইপ্যাড বের করে একটা ছবি মেলে ধরলো বার্কেনাভের
দিকে।তার চোখটা তখন বড় বড় হয়ে গেল।ছবিটা ছিল সেই ওয়াগনের।যে ওয়াগনকে সবাই
বার্কেনাভের ওয়াগন বলে চেনে।ছবিটা দেখার পর বার্কেনাভ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লো।সম্ভবত
এই প্রথম বার্কেনাভের চোখে পানি আসলো।সম্ভবত ওই প্রথম বার্কেনাভ কথা বললো।জার্মান
ভাষায় ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভাবে কথা বললো বার্কেনাভ।মিস্টার অ্যালেক্স আশ্চর্য হয়ে তার
মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।এই লোকটিকে সবাই পাগল বলে জানে এবং ধারে কাছেও কেউ
ঘেসেনা।লোক মুখে শোনা যায় বার্কেনাভ ওই ওয়াগনটিকে নিজের বলে দাবী করতো আর ওটার
কাছাকাছি পড়ে থাকতো। সরকারের কর্তাব্যক্তিদের আদেশে পুলিশ বার্কেনাভকে ওদিকে আর
ঘেষতে দেয়না। বাউন্ডারি দিয়ে রেখেছে তাই বার্কেনাভ সেদিকে যেতেও পারেনা।বার্কেনাভ যে
এখনো কিছুটা হলেও স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারে এটাই হয়তো কেউ জানেনা।
হিটলার নরপিশাচের মত অত্যাচারে লিপ্ত হয়ে উঠলো্। যাকে
যেখানে পেয়েছে বিশেষ করে ইহুদিদের সে নিয়ে আসছে এখানে।কারো একদিনের জীবন, কারো বা
বছরের পর বছর বন্দি জীবন কেটেছে অনাহার অর্ধাহারে।বার্কেনাভ বলছে আর ফাহিম এবং
মিষ্টার অ্যালেক্স মন্ত্রমুগ্ধের মত তা শুনছে। ফাহিম তার ভাষা বুঝছেনা দেখে
অ্যালেক্স বার বার ভাষান্তর করে দিচ্ছে।
এক সকালে বার্কেনাভকে তার বাবা মা ঘুম থেকে ডেকে তুললো।বাক্স পেটরা গুছিয়ে তারা
চললো কোন এক অজানার উদ্দেশ্যে।বার্কেনাভের বয়স তখন ছয় কি সাত বছর।বাবা মার সাথে সে
কোথায় যাচ্ছে তা তার জানা ছিলনা। ওরা চেকোশ্লোভাকিয়াতে বাস করতো।ওদের আদি নিবাস
ছিল ওটা।চেকোস্লোভাকিয়া থেকে হাজার হাজার মানুষকে ট্রেনে তোলা হলো। ট্রেনের সেই
বগিতে গাদাগাদি করে বার্কেনাভরা উঠে বসলো। ট্রেনটি ছুটে চলেছে ক্রাকভ শহর থেকে ৫০
কিলোমিটার দূরে আসভিচ (Auswitch) নামের একটা ছোট্ট গ্রামে।সময়টা ১৯৪৩ সাল।
বার্কেনাভের অতটা মনে নেই।এর পর একে একে দুই ভাগে ভাগ হয়ে
গেল বার্কেনাভ আর তার মা ও বাবা।বাবা আর মাকে একটা ওয়াগনে করে কোথায় যেন নিয়ে
যাওয়া হলো আর ছোট্ট সাত বছরের বার্কেনাভ থেকে গেল অন্য একটা দলের সাথে।সেই দলে ওর
বয়সী এবং ছোট বড় অনেক ছেলে মেয়ে ছিল।সেই সাথে ছিল বৃদ্ধ বয়সী অনেক মানুষ।একটা ঘরে
নিয়ে ওদের পোষাক জুতো সব খুলে নেওয়া হলো।তার পর সেই ওয়াগনে তুলে দেওয়া হলো।
সেই ওয়াগনে ছিল শুধু মাত্র ওর বয়সী এবং ওর থেকে ছোট বড় আরো
চল্লিশ জন ছেলে মেয়ে।কারো শরীরে কাপড়ের ছিটেফোটাও নেই। সবাই ভয়ে কান্নাকাটি
করছে।কে উলঙ্গ তার দিকে কারো নজর নেই।ছোট্ট বার্কেনাভ তখন দিশাহারা,বাকহারা। কি
হচ্ছে তা তার ধারনা নেই।ওয়াগনের সবার চিৎকার আর কান্নার শব্দে কান ফেটে যাওয়ার
জোগাড়। হঠাৎ ছোট্ট বার্কেনাভ শুনতে পেল কে যেন বলছে পালিয়ে যাও,ওরা তোমাদের মেরে
ফেলবে। গ্যাস চেম্বারে ঢোকানোর কিছুক্ষণ আগে ফাঁকা জায়গাতে ওদের ওয়াগনটা কিছু
সময়ের জন্য থেমেছিল।তখন অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে।ওয়াগন চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল যে এসএস
সৈন্য সে কয়েক মিনিটের জন্য গাড়ি থামিয়ে কোথায় যেন চলে গেল।ওয়াগনের ভিতরে বাতাস
ঢোকার জন্য ছোট্ট একটা জানালা ছিল সিক বিহীন।বার্কেনাভ ছিল অত্যন্ত রোগা এবং
কৃষ্ণবর্ণের। অনায়াসেই সে ওই জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেল।অন্যরা কেউ বের হলো কিনা তা
বার্কেনাভের মনে নেই।সেই অন্ধকারে মিশে গেল তার শরীরের কালো রং।তার পর উলঙ্গ
অবস্থায় ছুটে কিভাবে কিভাবে যে বেরিয়ে গেল তা আর বার্কেনাভ মনে করতে পারেনা।
বার্কেনাভের ভাষায় সেই যে ছুটে বেরিয়ে আসা এবং সেই যে
পালিয়ে যাওয়ার কথাটা ওই ওয়াগনই বলেছিল।তার মনে ওই ওয়াগন কথা বলতে পারতো।
পালিয়ে যাওয়ার পর কোথায় আর যাবে?ছোট্ট বার্কেনাভের কেবলই
মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে হয়তো এমন কোন জায়গাই নেই যেখানে হিটলারের নাৎসি বাহিনী নেই।এর
পর কিভাবে কোথায় কেটেছে তা বার্কেনাভের মনেও পড়েনা।ফাহিম জানতে চায় এর পর কি কোন
দিন ওই ওয়াগনের কাছে গিয়েছেন?কথা বলেছেন? কিংবা কিভাবে জানলেন ওই ওয়াগনটাই সেই
ওয়াগন? ফাহিমের কথাগুলো ভাষান্তর করে দেয় মিস্টার অ্যালেক্স।শুনে আরো আপ্লুত হয়
বার্কেনাভ।তার কথা বলা দেখে মনেই হয়নি সে পাগল।আসলেও বার্কেনাভ পাগল নয়।তার স্মৃতি
তাকে পাগলের মত আচরণ করতে বাধ্য করেছে।
বাকের্নাভ জানায় সে সুস্থ্যভাবেই বেড়ে উঠেছিল। সে কিভাবে
কিভাবে যেন বুলগেরিয়াতে চলে গিয়েছিল। আজ থেকে উনত্রিশ বছর আগে সে যখন এখানে এসেছিল
ঠিক ফাহিমের মতই ঘুরতে। তখন ওই ওয়াগনটার সামনে যেতেই ওয়াগনটা কথা বলে উঠেছিল।
বলেছিল বার্কেনাভ তুমি বেঁচে আছ? তোমার সাথে দেখা হবে তা ভাবিনি।আমি আশেপাশে
তাকিয়ে দেখলাম কে কথা বলে।নাহ আশে পাশে আমার ভাষাভাষি কাউকে দেখলাম না।তখন আপন মনে
বিড়বিড় করে বললাম কে কথা বলে?ওয়াগন তখন বলেছিল আমি তোমাকে পালিয়ে যেতে বলেছিলাম
মনে পড়ে?আমার দিকে তাকাও,আমি তোমার সেই ওয়াগন, যেটাতে তোমাকে গ্যাস চেম্বারে
ঢোকানো হচ্ছিল।“
সেদিন ওই কথাটুকু শোনার সাথে সাথে মুহুর্তেই বার্কেনাভের
পুরোনো সেই স্মৃতি মনে পড়েছিল। সে অন্য সব পযর্টকদের সামনেই হাউমাউ করে কেঁদে ওই
ওয়াগনটিকে জড়িয়ে ধরে কথা বলেছিল।সেদিনই সবার চোখে বার্কেনাভ পাগল বলে পরিচিত হয়ে
গেল।এর পর আর কোন দিন বার্কেনাভ বুলগেরিয়াতে ফিরে যেতে পারেনি।যে ওয়াগনের জন্য
বার্কেনাভ হিটলারের নির্মম হত্যাকান্ড থেকে বেঁচে গিয়েছিল সেই ওয়াগনকে রেখে
বার্কেনাভ কি করে বুলগেরিয়াতে ফিরে যাবে?
আস্তে আস্তে একদিন দুদিন করতে করতে হাজার হাজার পযর্টকের
কাছে বার্কেনাভ পরিচিত হয়ে উঠলো তার আর তার ওয়াগনের কথোপকথনের কারনে। সেই থেকে ওই
ওয়াগনটি হয়ে উঠলো বার্কেনাভের কথা বলা ওয়াগন। বার্কেনাভের মুখের কথা ভাষান্তর হয়ে
যখন ছোট্ট ফাহিমের কাছে আসছিল তখন তার চোখ বেয়ে অবিরাম অশ্রু ঝরছে।সেই সাথে
মিস্টার অ্যালেক্সের চোখেও।
ওরা বার্কেনাভের বলা কোন কথাই অবিশ্বাস করেনি।গোটা দুনিয়া
হয়তো অবিশ্বাস করবে কিন্তু ফাহিম আর মিস্টার অ্যালক্স তা অবিশ্বাস
করবেনা।নগ্নপ্রায় পাগল বলে পরিচিত বার্কেনাভকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে ফাহিম।বার্কেনাভ
বুঝে উঠতে পারেনা।একটু সময় নিয়ে সেও জড়িয়ে ধরে ওকে।এটা দেখলে কারো মনেই হতো না এই
বার্কেনাভ পাগল এই বার্কেনাভ হিটলারের বানানো গ্যাস চেম্বারে ঢুকে মরতে মরতে বেঁচে
এসেছে।
.........................................................................
২৮ মার্চ ২০১৬
উত্তরা,ঢাকা-১২৩০
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন